কারাগারে কেমন আছেন এম এ আউয়াল, মামলার তদন্ত কতদূর?

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০৪ | আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:১৫

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

রাজধানীর পল্লবীতে জমি নিয়ে বিরোধে শিশুপুত্রের সামনে খুন হন সাহিনুদ্দিন সাহিন। এই নৃশংস খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে। সাহিনকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল আউয়ালের কলাবাগানের অফিসে বসে। খুনের পর অপরাধীদের একজন আউয়ালকে ফোনে বলেন, ‘স্যার ফিনিশড’।

আলোচিত এই হত্যা মামলায় প্রধান অভিযুক্ত সাবেক এমপি আউয়ালকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গ্রেপ্তারের পর থেকে এখনো কারাগারে রয়েছেন তিনি।

সাহিন হত্যা মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দিলেও ভুক্তভোগী পরিবারটি (সাহিনের পরিবার) আদালতে নারাজি দেয়। বর্তমানে আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুনঃতদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

এম এ আউয়াল তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে তরিকত ফেডারেশন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। শৃঙ্খলাভঙ্গ ও নিয়মবহির্ভূত কাজ করায় ২০১৮ সালে আউয়ালকে দল থেকে বহিষ্কার করে তরিকত ফেডারেশন। এর পরের বছরই ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন আউয়াল।

পল্লবীর সেকশন-১২ বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকার হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে তার। আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ১০ একর জমি জবরদখলে বাধা দেওয়ায় সাহিনুদ্দিন সাহিনকে খুন করা হয়। নিহতের বাসা পল্লবীর ডি-ব্লকে।

এদিকে নিহত সাহিনের পরিবার বলছে, বর্তমানে কারাগারে বসেই বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে আউয়াল। এ কারণে আউয়ালের লোকজন আমাদেরকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। বিশেষ করে সাহিনের ছোটভাইকে মামলা দিয়ে কারাগারে রাখলে বা হত্যা করতে পারলে জমি দখলে আর কোনো বাধা থাকবে না।’

সম্প্রতি, স্থানীয় একটি মারামারির ঘটনায় নিহত সাহিনের ছোটভাইকে আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি যে জমির জন্য সাহিনকে হত্যা করা হয়েছে, সেটার একটি অংশ পুনরায় বে-দখল হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পরিবারটির।

 

যেভাবে হত্যা করা হয় সাহিনকে

গতবছরের ১৬ মে বিকালে জমির বিরোধের বিষয়ে মীমাংসার কথা বলে সাহিনকে পল্লবী থানার ডি ব্লকের একটি গ্যারেজের ভেতর নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ দৃশ্য স্থানীয় কেউ একজন ভিডিও ধারণ করেন। প্রকাশ্য দিবালোকে লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডে ভিকটিমের মা আকলিমা বেগমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঘটনার পরের দিন পল্লবী থানায় মামলা হয়।

মামলার এজাহারে আকলিমা বেগম উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন সুমন ও টিটু নামের দুই যুবক তার ছেলেকে জমির বিরোধ মেটানো হবে জানিয়ে ফোন করে ডেকে নেন। এ সময় তার সাতবছরের ছেলে মাশরাফিকে মোটরসাইকেলে নিয়ে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে গেলে সুমন ও টিটুসহ ১৪-১৫ জন মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়।
গ্যারেজে ঢুকিয়ে সাহিনকে চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এরপর তাকে ওই গ্যারেজ থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে আবার কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। এর পর ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত মনির ও মানিক নামে দুই জন র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।

 

জমির দালাল থেকে যেভাবে উত্থান আউয়ালের

রাজনৈতিক ক্ষমতা আর নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপটে কোনো কিছুই পরোয়া করতেন না এম এ আউয়াল। জাল-জালিয়াতি, ভূমি দখল ও প্রতারণায় সব সময় বেপরোয়া ছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরও বেড়ে যায় বহু গুণ। বাড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় তার মাস্তানিও। বাড়তে থাকে দখল ও হামলার দৌরাত্ম্য।

একসময় কিছুই ছিল না যার, সেই আউয়ালের উত্থান জমির দালালি দিয়ে শুরু। এরপর দখল-জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছেন বিপুল অর্থের মালিক। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুরের পল্লবী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক এই এমপি। সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা তার নেশা হয়ে গিয়েছিল।

 

জমি দখলে নিতে হত্যায় জড়ান আউয়াল

পৈতৃকসূত্রে মিরপুর সিরামিকসের ভেতরে এক বিঘার বেশি পরিমাণ জমির মালিক ছিলেন নিহত সাহিনের দাদা। পরবর্তী সময়ে এর মালিক হন তার বাবা জৈনুদ্দিন। তার মৃত্যুর পর সাহিনেরা (দুই ভাই) জমি দেখভাল করছিলেন। আউয়ালের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড’ কম টাকায় এই জমি কিনে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় সাহিনের দুই ভাইয়ের নামে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মাদক মামলা দেওয়া হয়। আর এই সব কিছু করেন সাবেক সংসদ সদস্য আউয়াল।

সাহিনের মা আকলিমা বেগম বলেন, ‘আউয়াল ১০ কাঠা জমি কিনতে আমাদের তার অফিসে ডেকে নিয়েছিলেন। তখন আমরা বলেছিলাম, জমির ন্যায্য দাম দেন, জমি দিয়ে দেব। পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের এই জমি থেকে তিনি সব সময় গায়ের জোরে আমাদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেন। আউয়াল ২০-২৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী পালেন, যারা সব সময় আমাদের জমি দখল করতে মরিয়া ছিল। আমার স্বামী মারা যাওয়ার আগে তার নামেও সাতটা মামলা দিয়েছিল আউয়ালের লোকজন।’

শনিবার কথা হয় আকলিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আউয়াল কারাগারে থাকলেও আমাদের পরিবারকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আর এসব করছে তার লোকজন। এলাকায় একটি মারামারির ঘটনায় সম্প্রতি পল্লবী থানায় আমার ছোট ছেলেকে আসামি করা হয়েছে। যার সঙ্গে সে কোনোভাবেই জড়িত না। তাছাড়া যে জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল, সেটাও মীমাংসা হয়নি। দিনকে দিন দখল হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের জমিতে নিজেরাই যেতে পারছি না। কারণ সব সময় প্রাণভয়ে বাড়িতেই থাকতে হয়।’

বর্তমানে সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। মামলা সম্পর্কে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে বর্তমানে আমরা মামলাটি তদন্ত করছি। এ ব্যাপারে বেশ অগ্রগতি আছে। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। কারণ আমরা সব মামলা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে থাকি।’

 

কারাগারে যেভাবে দিন কাটছে আউয়ালের

নাম প্রকাশ না শর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন ডেপুটি জেলার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রথম দিকে প্রায় প্রতিদিনই তার একাধিক ঘনিষ্ঠজন আসতেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা কমে গেছে। এখন মাঝেমধ্যে আসেন। আউয়াল কারাগারে আসার প্রথম দিকে অনেকটা বিমর্ষ থাকতেন। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। তবে ধীরে ধীরে তিনি স্বাভাবিক হয়ে গেছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আউয়াল এখন ডিভিশন সেলে আছেন। একজন খুনের মামলার আসামি কীভাবে ডিভিশন সেলে আছেন জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সাবেক সংসদ সদস্য হওয়ায় তাকে ডিভিশন সেলে রাখা হয়েছে। কারাবিধি অনুযায়ী তিনি সুযোগ-সুবিধা পান। আর তাদের জন্য একজন করে সহকারী দেওয়া হয়, যিনি সংশ্লিষ্ট বন্দির প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে দেন।

সূত্র জানায়, ডিভিশন সেলে বিছানা, টেবিল-চেয়ার, টেলিভিশন, ফ্যান, পত্রিকা পড়ার সুবিধাসহ বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তাদের খাবারও সাধারণ বন্দিদের চেয়ে উন্নত। আউয়াল দিনের বেশির ভাগ সময় টিভি আর পত্রিকা পড়ে সময় কাটান। তার সেল সংলগ্ন সেলে একজন বন্দি রয়েছেন। তার সঙ্গে গল্প করেন। এ ছাড়া অন্য বন্দিদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না। তাছাড়া সরকারি বরাদ্দের খাবারই বেশি খান, মাঝে মধ্যে ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খান।

(ঢাকাটাইমস/২৪সেপ্টেম্বর/এসএস/এফএ)