কেন আত্মগোপনে ছিলেন মরিয়মের মা রহিমা, অনেক রহস্য
প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:৩৫
নিখোঁজের ২৯ দিন পর শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১১টার দিকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস বিশ্বাসের বাড়ি থেকে আলোচিত মরিয়মের মা রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে পুলিশ।
রহিমা খুলনা পিবিআইয়ের কাছে জানিয়েছেন, ২৭ আগস্ট রাতে পানি নেওয়ার জন্য নেমে অপহৃত হন। চারজন মিলে তাকে জাপটে ধরে নাকে রুমাল ধরে। এরপর থেকে তার কিছুই মনে নেই। তবে বোয়ালমারীর যে বাড়িতে তিনি ছিলেন সেই পরিবার আগে রহিমা বেগমের বাড়ি খুলনায় ভাড়া থাকতেন। তাদেরকে তিনি বলেছেন, ‘তিনি বেড়াতে এসেছেন। দুই-তিন দিন থাকবেন। তারাও অতিথি ভেবে স্বাভাবিক আচরণ করেছেন।
রহিমা জানান, মেয়েদের সঙ্গে তার শত্রুতা, মেয়েরা তাকে ভালো জানে না, মেয়েরা তাকে চায় না, তার সম্পত্তি চায়। প্রতিবেশীও তার সম্পত্তি চায়।
এদিকে ময়মনসিংহের ফুলপুরে পাওয়া লাশকে নিজের মা দাবি করে শনিবারও ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন মরিয়ম মান্নান। এসব ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রহস্য। পিবিআই জানিয়েছে, তারা রহিমা বেগমের বক্তব্য খতিয়ে দেখছে। পাশাপাশি সব ঘটনার তদন্ত করা হবে। রবিবার রহিমাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনার শুরু ২৭ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায়। ওই সময় রাহিমা বেগম (৫২) পানি আনতে বাসা থেকে নিচে নামেন। পরে দীর্ঘ সময় পার হলেও তিনি বাসায় না ফেরায় মায়ের খোঁজে সন্তানরা সেখানে গিয়ে তার ব্যবহৃত স্যান্ডেল, গায়ের ওড়না ও কলস রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন।
এ ঘটনার পর দৌলতপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি ও পরে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন তার মেয়ে। এ মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র্যাব। তারা হলেন- খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশল কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম কিবরিয়া, নিখোঁজের দ্বিতীয় স্বামী হেলাল হাওলাদার, দৌলতপুর মহেশ্বরপশা বণিকপাড়া এলাকার মহিউদ্দিন, পলাশ, জুয়েল ও হেলাল শরীফ।
ঘটনার বিষয়ে খুলনা পিবিআইয়ের কাছে মুখ খুলেন রহিমা বেগম। রবিবার বেলা ৩টায় খুলনা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান জানান, রহিমা বেগম তাদের জানিয়েছে, ‘২৭ আগস্ট রাতে পানি নেওয়ার জন্য নেমে অপহৃত হন। চারজন মিলে তাকে জাপটে ধরে নাকে রুমাল ধরে। এরপর থেকে তার কিছুই মনে নেই।’
খুলনা পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রহিমা অপহৃত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। অপহৃত হওয়ার কিছু দিন পর এক হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে মুকসুদপুরের বাসে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে পরিচিতদের কাছে কয়েকদিন কাটান। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার সৈয়দপুরে কুদ্দুসের বাড়িতে ওঠেন। সেখানেই তিনি অবস্থান করছিলেন।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সৈয়দপুরে অবস্থানের সময় এ ঘটনাটি আলোচিত হলে স্থানীয় একজন বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নজরে নেন। ওই জনপ্রতিনিধি এ বিষয়টি খুলনার দৌলতপুরের একজন কাউন্সিলরকে জানান। তিনি ঘটনাটি দৌলতপুর থানায় জানালে পুলিশ ২৪ সেপ্টেম্বর ওই এলাকায় গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
রহিমা বেগম জানিয়েছেন, অপহরণের পর কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে তিনি জানেন না। সেখানে গিয়ে সাদা স্ট্যাম্পে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। সেখানে যাদের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে গণ্ডগোল তাদের মধ্যে কিবরিয়া, মহিউদ্দিন নামে কেউ ছিলেন।
রহিমা বেগম আরও জানান, এরপর তাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। তখন নাকি তারা হুমকি দিয়ে আরও বলে, ‘তোকে ছেড়ে দিলাম প্রাণে মারিনি।’
এতদিন কেন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি জানতে চাইলে রহিমা বলেন, ‘আমার কাছে কোনো মোবাইল ফোন ছিল না।’
খুলনায় না আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'যারা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা আমাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। আমি ভয়ে খুলনায় আসিনি।'
রহিমা বেগম আরও বলেন, যখন তাকে অপহরণ করা হয় তার স্বামী বেল্লাল ঘটক দোতলায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। রহিমা বেগম তাকে নামতে নিষেধ করেন এবং নিরাপদে দরজা আটকে দিতে বলেন।
এদিকে রহিমা বেগম ফরিদপুরে যাদের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন সেই কুদ্দুস মোল্লার এক আত্মীয় শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) মরিয়ম মান্নানের পরিবারে ফোন করে রহিমার অবস্থানের বিষয়ে তথ্য দেন। কিন্তু এই নামের কাউকে চেনেন না বলে ফোন কেটে দেন মরিয়মের ভাই মিরাজ আল সাদীর স্ত্রী।
রহিমার বিষটি শুক্রবার এ বিষয়ে জানতে পারেন কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে জয়নাল ব্যাপারী। তিনি জানান, মোবাইল ফোনে শুক্রবার তিনি রহিমা বেগমের নিখোঁজ সংবাদ দেখেন।
জয়নাল ব্যাপারী আরও জানান, ‘‘রহিমা বেগমকে সেই ভিডিও দেখালে তিনি বরে 'এটা তো আমি'। তখন তাকে খোঁজা হচ্ছে জানালে সে বলে 'আমি বাড়ি ফিরে যাব না।’’
পরবর্তীতে আমি আরও সার্চ করতে থাকি মোবাইলে। তখন নিখোঁজ বার্তায় রহিমা বেগমের ছেলে মিরাজের নম্বর পাই। শুক্রবার রাতেই মিরাজের নম্বরে কল দিলে তার স্ত্রী ফোন রিসিভ করে। আমি তাকে বলি রহিমা বেগম এখানে আছে। তখন অপর পাশ থেকে বলে 'আমি ওনাকে চিনি না। এ নম্বরে আর ফোন দেবেন না। এরপর সে ফোন কেটে দেয়।’’
কুদ্দুস মোল্লার মেয়ের জামাই নূর মোহাম্মদ জানান, রহিমা বেগম আমাদের এখানে এসে বলেছিলেন সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেশী ও মেয়েদের সঙ্গে রহিমা বেগমের বিরোধ চলছে। এ কারণে তিনি বাড়ি থেকে চলে এসেছেন।
‘আমাকে একটা কাজ খুঁজে দেন, আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। যেকোনো কাজ, ইটভাটার হোক, জুট মিলের হোক বা বাসাবাড়ির হোক। আমার মেয়েদের সঙ্গে আমার শত্রুতা, মেয়েরা আমাকে ভালো জানে না, তারা আমাকে চায় না, আমার সম্পত্তি চায়। প্রতিবেশীও আমার সম্পত্তি চায়।’
কুদ্দুস মোল্লার প্রতিবেশীদেরও একই কথা বলেছেন রহিমা বেগম।
নূর মোহাম্মদ জানান, রহিমা বেগম ১৭ সেপ্টেম্বর তাদের বাড়িতে আসেন।
তবে ফোন করার বিষয়ে জানতে চাইলে তার ছেলে মিরাজ বলেন, ‘সেদিন রাতে আমার দুটি ফোনই ছিল বোন মরিয়ম মান্নানের কাছে। আমার ফোন কখনই স্ত্রীর কাছে থাকে না। সে সময় কেউ ফোন করে বোনকে মায়ের বিষয়ে তথ্য দিয়েছিল কি না সেটি আমার জানা নেই।’
এদিকে রহিমা বেগমের সন্ধান চেয়ে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক মাস ধরে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তার সন্তানরা। ময়মনসিংহের ফুলপুরে অজ্ঞাতপরিচয় নারীর মরদেহকে নিজের মায়ের দাবি করে বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন মরিয়ম মান্নান। শুক্রবার রহিমা বেগমের মেয়েরা ফুলপুরে গিয়ে অজ্ঞাত মহিলার লাশকে ‘নিজেদের মায়ের লাশ’ দাবি করলে চাঞ্চল্য তৈরি হয়।
এ সময় তিন বোনকে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের ছবি, পরনের গোলাপি রঙের সালোয়ার; গায়ে সুতির ছাপা গোলাপি, কালো-বেগুনি ও কমলা রঙের কামিজ এবং গোলাপি রঙের ওড়না দেখায় পুলিশ। সাথে এও জানানো হয় নিহত নারীর বয়স ২৮ থেকে ৩০ বছর। তাও তারা অজ্ঞাত মহিলাকে নিজের মা দাবি করে।
তবে পুলিশ তাদেরকে জানায়, লাশটি অর্ধগলিত থাকায় ছবিতে তেমন বুঝা যাচ্ছিল না। মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে। এরপর মরিয়ম নিজের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার আবেদন করেন।
খুলনা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকের রহমান জানিয়েছেন, ঘটনার তদন্ত কার হবে। তবেই বিস্তারিত সঠিক রহস্য বেরিয়ে আসবে।
বর্তমানে এ মামলা তদন্ত করছেন পিবিআই পরিদর্শক আব্দুল মান্নান।
(ঢাকাটাইমস/২৫সেপ্টেম্বর/কেএম)