বাংলাদেশে রোগীর তথ্য অধিকার

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:১৩ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৫৯

ড. ফরিদ আহমেদ ও ড. সোচনা শোভা

রোগীর তথ্য অধিকার অন্য যে কোন অধিকারের মত উন্নত বিশ্বে সার্বজনীনরুপ লাভ করেছে। রোগীর তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নৈতিক সুশাসন কাঠামোর অংশ হিসেবে উন্নত দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় আইনও করা হয়েছে। আদালতও রোগীর এ অধিকার সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছে। যেমন, ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যম্যাসাসিউট একটি আইন প্রণয়ণ করে। সেই আইন চিকিৎসকে নির্দেশ প্রদান করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি , কি কি সম্মান ও পুরষ্কার তিনি এ পর্যন্ত  অর্জন করেছেন, তিনি কোন ধরণের বীমা পলিসি নিয়েছেন ইত্যাদি বিষয় রোগীদের কাছে প্রকাশ করতে হবে, যাতে চিকিৎসক নির্বাচনে রোগী বা তাঁর প্রতিনিধি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

রোগীকে রোগ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, তাঁকেই তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে তোলা, রোগীর আত্মসম্মানবোধকে স্বীকার করা বিষয়গুলোর নৈতিক ও প্রয়োগিকমুল্য আছে। রোগীর স্বাধীনতা ও তাঁর প্রকৃত ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে বা জানতে চিকিৎসক ও সমাজ রোগীর জানার অধিকারকে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। এ দৃষ্টিকোণটি ইমানুয়েল কান্টের কর্তব্য পালন নীতি ও সদ্দ্চ্ছিার নীতি এবং এরিষ্টটল এর সদগুণ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষনও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে।

রোগীর তথ্য অধিকার অস্ট্রেলিয়াতে অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন জানা যায় এক ভারতবংশীয় আমেরিকান ডাক্তার অপারেশান করে অনেকগুলো রোগী মেরে ফেলেছেন। ঐ ডাক্তারের কর্মকান্ডকে নৈতিক অনুমোদন সমাজ দেয়নি। বাংলাদেশেরর্সাজনসর্ম্পকে আমরা ভয়াবহ সংবাদ পত্রকিার পাতায় দেখতে পাই।   সম্প্রতি জানা  গেছে নামী এক হাসপাতালরে এক র্সাজন  রোগীর দুটো কিডনিফেলেদিয়েছেন ! ওই সব সংবাদ রোগীদেরবিদেশেযেতেঅনুপ্রাণিতকরে এসব বাস্তব সমস্যা থেকে উন্নত দেশগুলো নজর দেয় রোগীর তথ্য অধিকার পর্যালোচনায়। আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রোগীর তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে শল্য চিকিৎসাবিদদের রিপোর্ট কার্ড প্রবর্তনের বিষয়টি নৈতিক বিবেচনায় গুরুত্ব পায়। গবেষকরা মনে করেন, সার্জনদের রিপোর্ট কার্ড রোগীর তথ্য অধিকার সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিবেচ্য বিষয় বাংলাদেশের সার্জনদের জন্য  এমন একটি পদ্ধতি প্রবর্তন করা যায় কিনা?

রোগীর তথ্য অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৪ সালে A Declaration on the Promotion of Patients’ Rights in Europe শিরোনামে একটি ডিকলারেশান  প্রকাশ করে। এই ডিকলারেশানে মুলত রোগীর সামাজিক অধিকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিধ্বনিত্ব হয়েছে। প্রথমত: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই ঘোষণা ইঊরোপে রোগীর তথ্য অধিকারের স্বীকৃতি সনদ। নীতিদার্শনিকদের কাছে প্রতীয়মান হয়, সমাজ যদি রোগীর তথ্য অধিকার স্বীকার না করে, তবে প্রকারন্তে তার চিকিৎসার অধিকারকে অস্বীকার করা হয়- যা অনৈতিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, Òeveryonehas an equal opportunity to enjoy the highest attainable level of health.” এবং তাঁদের এই স্বাস্থ্য অধিকার ভোগে যেমন আছে স্বাধীনতা তেমনি আছে তথ্য অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার।  রোগীর স্বাস্থ্য অধিকার থেকেই রোগীর তথ্য অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত হয়। কারণ রোগীর স্বাধীনতা নিশ্চিত না করে তথ্য অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্বে অংশ গ্রহণের অধিকার ও সর্বোপরি স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। রোগীর তথ্য অধিকার থাকলে রোগী চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারে।

উন্নতদেশে রোগীর স্বাস্থ্য অধিকারের বিষয়টি যেভাবে সকলের নজরে এসেছে, যেভাবে তাঁদের সমাজ রোগীর তথ্য অধিকার বা জানার অধিকার অর্জনে মানুষকে সচেতন করেছে, বাংলাদেশে আজও সেভাবে বিষয়গুলো স্বীকৃতি লাভ করেনি। আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল যখন বাংলাদেশে নাগরিকের জন্য তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ পাশের তোড়জোড় চলছিল। আমাদের আশা ছিল রোগীর তথ্য অধিকারও এই আইনে স্থান পাবে। কিন্তু বাস্তবত: সেরুপ হয়নি।

রোগীর তথ্য অধিকার সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্যর সংস্থা ঘোষণায় বলা হয়েছে,  

Patients have the right to be fully informed about their health status, including the medical facts about their condition; about the proposed medical procedures, together with the potential risks and benefits of each procedure; about alternatives to the proposed procedures, including the effect of non-treatment; and about the diagnosis, prognosis and progress of treatment.

এরকম একটি স্বীকৃতি আজও কেন বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ বিবেচনা করেনি সেটিও গবেষণার বিষয়। আমাদের অভিমত, যদি এধরণের স্বীকৃতি বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়, তাহলে “সবার জন্য স্বাস্থ্য” নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জন সহজতর হবে।

সমালোচকরা মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীকে তথ্য দেওয়ার নামে রোগীকে পুঁজি করে বাণিজ্য করেন। আর তাই তিনি তথ্য প্রদান করতে গিয়ে এমন সব কথা বলেন যা রোগীর রোগ না থাকলেও সাধারণ মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এমনি এক কঠিন পরিস্থিতি থেকে উওরণের জন্য বাংলাদেশের রোগী ও তাঁদের পরিবার পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান করছে। রোগীদের এই করুণ অবস্থা নি:সন্দেহে আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তোলে।

রোগীর যেমন তথ্য পাওয়ার অধিকার আছে তেমনি চিকিৎসক বা হাসপাতাল রোগীকে তথ্য প্রদানে বিরত থাকতে পারে যদি তাঁরা মনে করে তথ্য প্রদান করলে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। যুক্তি দেওয়া হয়, মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা নিশ্চিত করতে ও রোগীরা যাতে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে বা প্রয়োজনে বিচার চাইতে পারে সেজন্য রোগীর তথ্য অধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না অনুন্নত দেশের মত বাংলাদেশে রোগীর তথ্য অধিকার দারুণভাবেউপেক্ষিত। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিরাজমান রয়েছে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। তাতে করে বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও সম্পদ হুমকির মুখে। আজকাল আমরা দেখতে পাই চিকিৎসকরা নিজেরাই ভরসা রাখতে পারেন না তাঁদের সহকর্মী বা তাঁদের শিক্ষাগুরুদের প্রতি। তাই সামর্থ থাকলেই চলে যান ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর। সেখানে গিয়েও যে সুখকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা বলা যাবে না। কারণ, আমাদের জানামতে এক চিকিৎসক বিদেশে চিকিৎসা করিয়েদেখলেন তাঁর অপারেশানেত্রুটি রয়েগেছে। তিনি দেশে ফিরে দেশের ডাক্তারদের দিয়ে সেই ত্রুটিটি নিরাময় করেন।

ডাক্তারের প্রতি রোগীদের অনাস্থার কারণে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিদেশে চলে যাচ্ছে অপরদিকে দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এড়াতে অনেক ভাল ডাক্তার পরিবার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। তাতে মেধা ও সেবা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। চিকিৎসারনৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এত ব্যাপক যে বাংলাদেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মানুষগুলোও বিদেশে চলে যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে।

ভারতের তথ্য কমিশনার শ্রীধর আচার্যও বলেন, রোগীরা তাঁদের মেডিকেল রেকর্ড অবশ্যই পেতে পারেন। কারণ এটি তাঁদের একটি সংবিধান সম্মত অধিকার যা ভারতীয় সংবিধানে ১৯ ও ২১ আর্টিকেলে বিধৃত আছে। এবং এটি প্রদান করা হাসপাতালগুলোর একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য। অপরদিকে, ভারতের আইনমন্ত্রী তথ্য অধিকারের সমর্থনে বলেন,মেডিকেল রেকর্ড সহজলভ্য হলে রোগীকে কোর্টকাছারীতে যেতে হবে না বিচারের জন্য। তাঁরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন যদি রোগীর এই অধিকার সংরক্ষণ না করা হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাঁদের দায়িত্ব পালন না করেন।

উপরোক্ত মন্তব্যগুলো থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে,শুধু ঊন্নত দেশগুলোই নয় প্রতিবেশী দেশ ভারতও রোগীর তথ্য অধিকার রক্ষায় অনেক দুর এগিয়ে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, রোগী শুধু একজন ভোক্তা নন, আর চিকিৎসকও একজন ব্যবসায়ী নন বরং রোগী একজন মানুষ যাঁর মর্যাদাবোধ আছে, আছে অনেকগুলো মৌলিক অধিকার। সুতরাং, চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শুধু সংবিধান ও দেশের আইন মেনেই চলবেন না, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নৈতিক মানদন্ডগুলোও তিনি পেশাদারিত্বের বেলায় প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এভাবে একজন চিকিৎসক নিজের মর্যাদা ও রোগীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারেন। মানব মর্যাদা সমুন্নত রাখাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

আমাদেরদেশেফার্মেসিগুলোতেযারা আছেনতাদেরঅনেকেরই ডিগ্রী বা অভিজ্ঞতানেই।যেখানে সব ধরণের ব্যাথাকে একই রকম মনে করে ব্যাথার ঔষুধচাইলে ভালো করে না জেনেপ্যারাসটিামলদেয়াহয়, আবার জ্বর আছে বললে দেয়াএন্টিবায়োটিক হয়।  ডাক্তারকে রোগের কারণ, প্রেসক্রিপশনেলেখা ঔষধগুলো কোনটি কি কারণে দেয়া  হলো, কি র্পাশ্বপ্রতিক্রিয়া আছে বিষয়গুলো জানতে চাইলেক্ষিপ্ত হন। অথচ এটা তার একটি মৌলিকঅধিকার।এবং এই অধিকার থাকার পরেওআমাদের রোগীরা প্রশ্ন করতে ভয় পায়। এসব বিষয়গুরুত্ব সহকারেগবেষক ও সরকারকে ভাবতে হবে প্রকৃত উন্নয়ন র্অজনকরতে।

আজ বিশ্ব তথ্য অধিকার দিবস। এই দিবসের প্রাক্কালে আমাদের প্ৰত্যাশা রোগীর তথ্য অধিকার আইনে রূপান্তরতি হবে এবং সুখী সম্মৃদ্ধ বাংলাদশে গড়তে অবদান রাখবে।

 

লেখকদ্বয়ের মধ্যে ড. ফরিদ আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এবং ড. সোচনা শোভা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক