সাপের বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ২৫ শিক্ষার্থী!

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:৩০

আজহারুল হক, ময়মনসিংহ

সাপ দেখলেই লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায় সবাই। হইহই পড়ে যায় চারপাশে। সাপটি বিষধর হোক বা না হোক। অনেকেই আবার ভয়ে ছুটাছুটি শুরু করেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাপ মেরে তবেই ক্ষান্ত দেয় সবাই। হামেশাই এই চিত্র চোখে পড়ে।

কিন্তু একদল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণী এর ব্যতিক্রম। তারা সাপ মারতে নয়, বরং বাঁচাতে যান। সাপের সন্ধান পেলেই বা কেউ ফোন দিলেই নিজেদের উদ্যোগে ছুটে যায় এ দলটি। উদ্ধার করেন সাপ। তারপর আবার প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করে দেন।

সাপের এই বন্ধুর নাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ’। সবার কাছে এই সংগঠনটি এখন বেশ পরিচিত।

এ টিমের সদস্যরা গত এক বছরে বিষধরসহ ২ হাজার ২০০ সাপ লোকালয় থেকে উদ্ধার করে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেছে।

২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ২৫ জন সদস্য নিয়ে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ পেইজের মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে সাপ রেসকিউয়ের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুক পেইজে তাদের হটলাইন নাম্বার দেওয়া আছে। ওই নাম্বারে ফোন এলেই তারা ছুটে যান। তারা সিমটমমের মাধ্যমে বুঝতে পারেন এটা কি ধরনের সাপ। বর্তমানে সংগঠনটির ২৫ জন সদস্যর মধ্যে মাত্র দুজন কর্মজীবী, বাকি সবাই শিক্ষার্থী।

স্নেক রেসকিউ টিমের সদস্যদের সূত্রে জানা যায়, মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে একটি সহাবস্থান তৈরি ও সাপ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ। এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো লোকালয় থেকে মানুষকে রক্ষার মাধ্যমে সাপকে উদ্ধার করে তার প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়া।

‘স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ’-এর সাংগঠনিক সম্পাদক জোবাইদুর রহমান মেহেদী বলেন, বর্তমানে ১৮ জন সাংগঠনিক সদস্যা দ্বারা টিম পরিচালনা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য সাপ সম্পর্কিত একটি অনলাইনভিত্তিক কোর্সও চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগ্রহী ব্যক্তিরা এই কোর্সে অংশগ্রহণ করছেন। তাদের মাঝে আমরা সাপ সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে সাপ বিষয়ে করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে টিমে মোট সদস্য রয়েছেন ৫০ জন। তথ্য দিয়ে আরও ২০০ জন আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন সদস্য যুক্ত হচ্ছেন। সারা দেশেই সদস্য তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ জেলায় প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী তৈরি করার পরিকল্পনা কয়েছে।

এ টিমের নারী প্রচার সম্পাদক তাসমিয়া বলেন, আমার বাড়ি জামালপুরে। ফেসবুকের মাধ্যমে রাব্বী ভাইয়ের (টিমের প্রতিষ্ঠাতা) সাথে পরিচয়। আমার ছোটবেলা থেকেই সাপ ধরার খুব ইচ্ছে ছিল। পরে রাব্বী ভাইয়ের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সাপ ধরা শিখি। গত মে মাসেই আমরা ৫টি অজগর সাপ ধরেছি। ২০২২ সালেই ১২টি অজগর সাপ উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশের প্রথম লিউসিস্টিক জলঢোঁড়া সাপটিও আমাদের টিম উদ্ধার করেছে। সাপ ছাড়াও প্রায় ১ হাজারের উপরে অন্য বন্যপ্রাণী উদ্ধার এবং অবমুক্ত করেছে আমাদের টিম।

স্নেক রেসকিউ টিমের বর্তমান সভাপতি রাজু আহম্মেদ বলেন, রাব্বী ভাইয়ের কাছ থেকে সাপ ধরতে শিখেছি। এত আমার অনেক ভালো লাগে। আমি বেসরকারি রানার গ্রুপে চাকরি করি। সুযোগ পেলেই সাপ ধরতে ছুটে যাই। যে সাপগুলো বিপদগ্রস্ত, মানুষের বাসস্থানে ঢুকে পড়ে তাদের উদ্ধার করে সেগুলোকে প্রকৃতিতে তাদের অবস্থানে ফিরিয়ে দেই। এছাড়াও অসুস্থ সাপ এবং অন্য বন্যপ্রাণীর চিকিৎসার মাধ্যমে সেগুলো সুস্থ করে অবমুক্ত করি।

তিনি বলেন, এই টিম পদ্ম গোখরা, খৈয়া গোখরা, কিং কোবরা, শঙ্খিনী, ব্ল্যাক ক্রেইট, গ্রিন পিট-ভাইপারের মতো বিষধর সাপ এবং নির্বিষ অজগর, কুকরি, বেত আঁচরা, দুধরাজ, ফণিমনসাসহ ২ হাজার ২০০ বিষধর এবং নির্বিষ সাপ উদ্ধার করেছে। একই সঙ্গে বিষাক্ত প্রজাতির লাল-গলা ঢোঁড়া অসুস্থ সাপ উদ্ধার করে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে অবমুক্ত করেছি।

‘স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিকুর রহমান রাব্বি বলেন, ছোটবেলা মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সাপ দেখে ধরতে চাইতাম। সে সময় থেকেই আমার সাপের প্রতি ভয় কেটে যায়। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে সাপের খেলা দেখতাম আর তারা কি করে সাপকে কৌশলের মাধ্যমে আয়ত্ব করে তা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম। পরে বাসায় এসে ডিসকভারি চ্যানেলেও সব সময় সাপ দেখতাম। তখন থেকেই সাপ ধরার প্রতি নেশা জন্মায়। এগুলো দেখে কোনটি বিষমুক্ত আর কোনটি বিষাক্ত তা বুঝে নেই। শুরুর দিকে বিষমুক্ত সাপ ধরতে থাকি। এক সময় বিষাক্ত সাপকে ধরে ফেলি। এভাবেই একা একা কাজ শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, একসময় ফেসবুকে অনেক সাড়া পাই। অনেকেই সাপ ধরা শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে চিন্তা করি একটি টিমের মাধ্যমে কাজ করলে ভালো হয়। তারপর ২০২০ সালে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘স্নেক রেসকিউ টিম’ বাংলাদেশ নামে পেইজ খুলি। এক এক করে আমার টিমে সদস্য বাড়তে থাকে। আমি তাদের প্রশিক্ষণ দেই। এখন আমাদের টিমে মেয়ে সদস্যসহ বর্তমানে ২৫ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রেসকিউয়ার রয়েছে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ফোন এলেই আমরা সাপ উদ্ধার করতে ছুটে যাই। আমাদের টিমের সদস্যদের সবার কিছু কিছু টাকার মাধ্যমে ফান্ড তৈরি করা হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। আমাদের সাপ উদ্ধারে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে কষ্ট হয়ে যাই। যদি সরকার আমাদের টিমকে পৃষ্ঠপোষকতা করত, তাহলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম।  এতে মানুষকে রক্ষার পাশাপাশি সাপ সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা থেকে সচেতন করে প্রকৃতিও রক্ষা করা যেত।

(ঢাকাটাইমস/২৮সেপ্টেম্বর/এলএ)