ইডেন ছাত্রীদের ‘ললাটে’ এই দুর্নাম ঘুচবে কবে

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:২২ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:০০

মিজান মালিক

অভিযোগ গুরুতর। কলেজ শাখার নেত্রীরা সাধারণ ছাত্রীদের যৌনকাজে বাধ্য করছেন। আবাসিক হলে একটা সিট বরাদ্দ পেতে বা পাওয়ার পর তা ধরে রাখতে ছাত্র রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে হয়। মিছিল- মিটিংয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। নেত্রীদের কথার বাইরে গেলে চলে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। ইডেন কলেজের ছাত্রীদের দুর্দশার গল্প এখন সবার মুখে মুখে। কতিপয় ‘ধূর্ত-দুর্বৃত্ত’ শ্রেণির নেত্রীর জন্য যুগের পর যুগ ধরে সাধারণ ছাত্রীরা ভুক্তভোগী। আর এখন তা ঠেকেছে ভয়ংকর অবস্থায়। কলেজের কর্তৃত্ব ছাত্রলীগের হাতে। আর বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনের কতিপয় কেন্দ্রীয় নেতার আসকারায় ইডেনের রাজত্ব করছে রিভাদের মতো কতিপয় ‘রাহাবাজ’ মেয়ে। মেয়েরা চাঁদাবাজি করে এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এরা সিট বাণিজ্য করে সেটাও শুনতে ভালো শোনায় না। শুধু সাধারণ ছাত্রীই নয়, সংগঠনের সাধারণ নেতাকর্মীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা, পদ-পদবি, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তাদের ব্যবহার করা, এসব অভিযোগ এখন ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। এক সাংগঠনিক সম্পাদকের বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে অনেক মেয়ে আকারে ইঙ্গিতে তাদের অভিযোগ জানিয়েছিল; এখন তা প্রকাশ্যে।

ইডেনের ছাত্রীদের নিয়ে চারদিকে শোরগোল, ছি. ছি! কী বিশ্রী ব্যাপার! বিষয়টা কেন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইডেনের ছাত্রীদের নিয়ে ট্রল হচ্ছে! একাধিক ভিডিও ক্লিপ করে তা বাজারে ছেড়েছে ইউটিউব ও ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ। তার একটিতে দেখানো হয়, ছেলে তার পাত্রী দেখতে যান। পাত্রীর সব বৃত্তান্ত শোনার পর ছেলের প্রশ্ন ছিল ‘কোন কলেজে পড়েছেন?’ জবাবে পাত্রী বলল ‘ইডেন কলেজ’। এটা শোনার পর দৌড়ে পালালো পাত্র। আরেকটা রম্য ভিডিওতে দেখলাম, বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে ভাড়াটিয়ার কাছে বাড়িওয়ালা জানতে চাইছেন ‘মেয়ে কোন কলেজে পড়ে?’  জানালেন ইডেনে। বাড়ি ভাড়া হলো না।

আমাদের সমাজে এমনিতেই হাজারো নেতিবাচক খবর, নেতিবাচক মানুষে ভরপুর। কারও সুখবরে খুশি হতে না পারলেও মন্দ খবরে বেশ উল্লাস হয়। ইডেনের ছাত্রীদের বেলায়ও তেমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা অত্যন্ত বেদনার। কষ্টের। অভিভাবক ও ছাত্রীদের জন্য বিব্রতকর।

সাধারণ ছাত্রীদের ব্যানারে গত দু’দিন ধরে ‘বদনাম’ গোছানোর জন্য মানববন্ধন, সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরাসহ নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা কোথায় গড়ালে ছাত্রীদের বলতে বাধ্য হতে হচ্ছে, ‘আমরা সবাই খারাপ না’। অথচ সমাজে আমাদের মন্দ মেয়ে হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

বুধবার ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই মামলায় তাদের সব অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা মনে করি, মামলার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার। সাধারণ নিরীহ শিক্ষার্থীদের ‘ললাটে’ যে কালিমা লেপন করা হয়েছে, তা ঘোচানোর জন্য হলেও স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্তে ভুক্তভোগী সবার বক্তব্য নেওয়া দরকার। যদি পুলিশের তদন্ত পক্ষপাতমূলক বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে হবে। এভাবে একটা ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠকে কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও দুষ্কৃতকারীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়তে দেওয়া যায় না। আবাসিক হলে সিট বাণিজ্য, দল করতে বাধ্য করা, মিছিল-মিটিংয়ে যেতে বাধ্য করা, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন করা, দম্ভ-অহংকার দেখানো---এর সবকটি অভিযোগের সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ এই কথা বলে চিৎকার-চেঁচামেচি না করে সুশিক্ষা ও মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ তৈরিতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

যে ছাত্রীরা আজ প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তাদের প্রতিবাদের ভাষা পড়তে হবে কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রকে। অনেক ছাত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা শুধু কয়েকজনের জন্য নয়, স্থায়ীভাবে ক্যাম্পাসে কিংবা আবাসিক হলে তাদের জন্য মানসিক চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে।

এই বিদ্যাপীঠের ছাত্রীদের ব্যাপারে সমাজে যে ভুল বার্তা যাচ্ছে তাতে এখনই লাগাম টানতে হবে। ওরা আমাদের কারও বোন, কারও সন্তান। ওরা সবাই খারাপ বা মন্দ না। দুই-চার জনের অপরাধের দায় তাদের সবার না। ওদের ব্যক্তি জীবন আছে। পরিবার আছে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন আছে। কোনোভাবেই যেন কারও কাছে হেয় প্রতিপন্ন না হয়, সেদিকে সবার নজর রাখা দরকার। সর্বোপরি ছাত্রীদের ওপর থেকে এই বিদ্যাপীঠের রাজনৈতিক কলংকের দায় মুছে ফেলতে হবে। তাদের জন্য শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সবাইকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ঢাকাটাইমস ও ঢাকাটাইমস২৪.কম