রামু সহিংসতা: সাক্ষ্য দিচ্ছে না কেউ, বিচার থমকে আছে ১০ বছর

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৪৩ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:০৮

ঢাকাটইমস ডেস্ক

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের রামুর বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা। সেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ১০ বছর আজ। ওই ঘটনায় মামলা হলেও সাক্ষীর অভাবে থেমে আছে বিচারকাজ। আসামিরা সবাই এখন জামিনে মুক্ত।

রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির অভিযোগ, ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় দায়ীরা কেউ শাস্তি পায়নি এখনো। এ ঘটনায় আটককৃতরা সবাই এখন জামিনে। অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। এ ঘটনা কেন ঘটেছিল পেছনের সেই কারণ ঘটনার ১০ বছরেও উন্মোচিত হয়নি। রাজনৈতিক বা দলীয় কোনো মনোভাব থেকে এ ঘটনা ঘটেনি। এটি একটি ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত ঘটনা। এ ঘটনায় কম বেশি দলমত নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন স্থিরচিত্র, ভিডিও ফুটেজ এবং তদন্ত প্রতিবেদনেও তার প্রমাণ মিলেছে।’

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যুবক উত্তম বড়ুয়া ফেসবুক পেজে পবিত্র কোরআন অবমাননার ছবি পোস্ট করেছেন- এমন অভিযোগে এক রাতে কয়েকশ বছরের পুরনো ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও ২৬টি বসতঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের পটিয়ার বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালানো হয়।

ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ১৯টি মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় ৩৭৫ জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাত ১৫ থেকে ১৬ হাজার জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে রামুতে একটি মামলা আপস-মীমাংসায় আদালতে খারিজ হয়ে যায়।

বাকি ১৮টি মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে বিচার কাজ থেমে আছে। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সাক্ষীদের অনেকবার সমন জারি করা হলেও আদালতে হাজির হচ্ছেন না।

মামলা সূত্রে জানা যায়, রামু থানায় দায়ের করা ৮ মামলায় মোট আসামি সাত হাজার ৮৭৫ জন। এর মধ্যে ১১১ জনের নাম-ঠিকানা উল্লেখ থাকলেও পুলিশ মাত্র ৭৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয় ১৩২ জনকে।

উখিয়া থানায় দায়ের করা ৭ মামলায় ৫ হাজার ৬২৪ আসামির মধ্যে ১১৬ জন, টেকনাফ থানার দুটি মামলায় ৬৫৩ আসামির মধ্যে ৬৩ জন, কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ২ মামলায় ১ হাজার ৩০ আসামির মধ্যে ৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়ার ৯ বছর পার হলেও এখনো কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। ওইসব মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সবাই এখন জামিনে মুক্ত।

বিচারকাজের স্থবিরতার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, ‘সাক্ষীর অভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া থমকে আছে। ১৮টি মামলার মধ্যে প্রায় ৯০০ জন আসামি ও ১৬০ জনের মতো সাক্ষী আছেন। মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। কিছু মামলা বিশেষ তদন্তাধীন আছে। এসব মামলার সাক্ষীদের নামে সমন জারি করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু কেউ সাক্ষ্য দিতে আসেন না। অধিকাংশ সাক্ষী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।’

সাক্ষীরা আদালতে আসলে প্রয়োজনে পুলিশী নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলেও জানান পিপি।

সাক্ষীর অভাবে মামলা ধামাচাপা অবস্থায় পড়ে থাকবে কি না এই প্রশ্নের জবাবে পিপি বলেন, ‘মামলা ধামাচাপা দেওয়ার কোনো সুযোগ আইনে নেই। আদালত সাক্ষীকে সমন দেবে। যদি সাক্ষী আদালতে হাজির না হন তাহলে প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করে আনা হবে। কিন্তু সাক্ষীরা যদি অনীহা প্রকাশ করে, তাদের গ্রেপ্তার করে এনেও জোর করে সাক্ষ্য দেওয়াতে পারব না। আমরা চেষ্টা করছি, অন্তত একটা মামলারও যেন সাক্ষ্য হয়।’

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু মামলার বিষয়ে বলেন, ‘বর্তমান ১৮টি মামলা বিচারাধীন আছে। বিচারিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রদানের একটা বিষয় জড়িয়ে আছে। আমরা জেনেছি, সাক্ষীর অভাবে বিচারিক কার্যক্রম থেমে আছে। আমি ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের এই অনুরোধ করব যে, আমরা সবাই যেন যার যার জায়গা থেকে আদালতকে সাহায্য করি। আমরা যেন হতাশ হয়ে না পড়ি। আমাদের সবাইকে আরও ধৈর্য ধারণ করতে হবে।’

রামু সহিংসতার রাতের ঘটনা স্মরণ করে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের পরিচালক শীলপ্রিয় থের বলেন, ‘২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ বিহারগুলোর ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেই সম্পদ ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। ঘটনাটি স্মরণ করলে এখনো কান্না আসে। দুর্বৃত্তরা আমাদের বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধপল্লি পুড়িয়ে দিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে, ধ্বংস করেছে শত শত বছরের বৌদ্ধ মূর্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্বরিত সিদ্ধান্তে আমাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ করে দেওয়া হয় বৌদ্ধ বিহারগুলো। আমরা হারিয়ে যাওয়া দিনের চেয়ে বর্তমানে অনেক ভালো আছি। এখন আমাদের সামাজিক সম্প্রীতি অটুট আছে। আগামী দিনেও সেই সম্প্রীতি অটুট রাখতে হবে সম্মিলিতভাবে।’

ফেসবুকে কোরআন অবমাননার ছবি ট্যাগকারী সেই উত্তম বড়ুয়া এখন কোথায়? কী অবস্থায় আছে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছে। সেই উত্তম বড়ুয়ার খোঁজ মেলেনি ১০ বছরেও। উত্তম বড়ুয়া রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের হাইটুপি গ্রামের সুদত্ত বড়ুয়া ও মাধবী বড়ুয়ার ছেলে। উপার্জনকারী একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে উত্তমের বাবা-মা এখন চরম দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন একদিন তাদের ছেলে উত্তম ঘরে ফিরে আসবে। উত্তম কোথায় আছে সেই বিষয়েও নিশ্চিত কোনো তথ্য জানা নেই পুলিশের কাছেও।  

কয়েকশ বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পুড়ে যাওয়ার ঘটনার পরপরই পোড়া মন্দিরে তৈরি হয়েছে সরকারি উদ্যোগে নান্দনিক অনেক স্থাপনা।

এদিকে রামুতে বুদ্ধমূর্তি, বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলার ১০ বছর পূর্তিতে মানবতা ও শান্তি কামনায় আজ দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করেছে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ।

রামুর লাল চিং ও মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে দমদমা-নবাবপুর ধর্মকীর্তি বৌদ্ধ বিহারের আজীবন অধ্যক্ষ ড. ধর্মকীর্তি মহাথের প্রধান ধর্মদেশক ও রামু পানেরছড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সুচারিতা মহাথের সভাপতিত্ব করবেন।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোরে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্ট পরিষ্কার দানসহ মহাসংঘদান, দুপুরে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন, অতিথি ভোজন, বিকালে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সন্ধ্যায় বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা।

কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের জন্য সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানান রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের সভাপতি কেতন বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়ুয়া।

(ঢাকাটাইমস/২৯সেপ্টেম্বর/এফএ)