প্রমত্তা বংশী-ধলেশ্বরী নদী মৃত্যুর দিন গুনছে

আহমাদ সোহান সিরাজী, সাভার (ঢাকা)
| আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২২, ১৩:৪৬ | প্রকাশিত : ০১ অক্টোবর ২০২২, ১৩:২৩
কালের প্রবাহে ভয়াবহ দূষণ আর দখলে নদীগুলো আপন মানচিত্র হারিয়েছে অনেক আগেই

সাভার ও ধামরাইয়ের বিভিন্ন স্থান দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা বংশী এবং ধলেশ্বরী নদী একসময় ছিল এই এলাকার তীরবর্তী মানুষের প্রাকৃতিক পানির প্রধান উৎস। কৃষি ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার হতো এই নদীর পানি। নদীতে চলত অনেক নৌকা। জেলেরা মাছ ধরে নির্বাহ করতো তাদের জীবিকা। শিশুরা মনের আনন্দে গোসল করতো এই নদীর পানিতে।

কালের প্রবাহে ভয়াবহ দূষণ আর দখলে নদীগুলো আপন মানচিত্র হারিয়েছে অনেক আগেই। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই দূষণ-দখল বাড়ছে। এখন দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, নদীগুলোর অনেক স্থানে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক স্থানের পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। বিষাক্ত এই কালো পানি ব্যবহার করতে পারছে না কোনো কাজেই, এই পানি গায়ে লাগলে শুরু হয় চুলকানি।

এ সব দূষণ ও দখল রোধে স্থানীয় নদী রক্ষা কমিটি মাঝে মধ্যে মিটিং, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেও দূষনের মাত্রা কমছে না বরং বেড়েই চলছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পানি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত বংশী ও ধলেশ্বরী নদীতে দূষণের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া দূষণে দায়ী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে।

‘‘ বংশী ও ধলেশ্বরী নদী দূষণের জন্য মূলত সাভারের আশুলিয়ায় বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরের ট্যানারিগুলো দায়ী। শুষ্ক মৌসুমে বিলের মধ্য দিয়ে নালা কেটে বিভিন্ন কারখানার কালো পানি বংশী নদীতে ফেলা হয়। - স্থানীয় বাসিন্দা

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম তালুকদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ধলেশ্বরী নদী দূষণে ট্যানারির বর্জ্যের দায় অনেক বেশি। কদিন আগে ঢাকার পরীক্ষাগার থেকে পানি পরীক্ষার একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। যেখানে তিন-চারটি প্যারামিটার এখনো মানমাত্রার বাইরে রয়েছে।

এ নদীতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিগ্রামের নিচে থাকার কথা থাকলেও এর বেশি পেয়েছি। পানিতে দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের পরিমাণ (টিডিএস) ১ লিটার পানিতে ২১০০ বা এর নিচে থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ৪ হাজারের ওপরে। বংশী নদী দূষণে দায়ী হিসেবে সম্প্রতি আমরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছি। সেগুলোর বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা শিল্পায়ন করেছি, নগরায়ণ করেছি কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলতে পারিনি। এর মধ্যেই তার কুফল ভোগ করছে নদী, দেশের বেশির ভাগ নদী এখন হুমকির সম্মুখীন।’

দূষণের মূল কারণ শিল্পবর্জ্য:

বংশী ও ধলেশ্বরী নদী দূষণের জন্য মূলত সাভারের আশুলিয়ায় বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরের ট্যানারিগুলোকে দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন। গত সোমবার বংশী নদীসংলগ্ন ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড) এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পেছনের দিকের বড় বিল বংশীর পানিতে তলিয়ে আছে। নদীর পানি চলে এসেছে ডিইপিজেডের দেয়াল পর্যন্ত। ওই বিলসহ পাশের বংশী নদীতে বিভিন্ন শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য নানাভাবে এসে মিশে যাচ্ছে।

ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম বাবু ঢাকা টাইমসকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে বিলের মধ্য দিয়ে নালা কেটে বিভিন্ন কারখানার কালো পানি বংশী নদীতে ফেলা হয়। এখন তো বিলে বেশি পানি আছে, তাই বোঝা যাচ্ছে না। ওই পানিতে পচা দুর্গন্ধ। বাতাস এলে বাড়ি পর্যন্ত দুর্গন্ধ চলে যায়।

হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়াশিল্প নগর ঘুরে দেখা যায়, ট্যানারি থেকে নালা দিয়ে বর্জ্যমিশ্রিত পানি গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে। আশপাশের কিছু জলজ উদ্ভিদ রাসায়নিকের প্রভাবে বিবর্ণ হয়ে গেছে। নদীর পাড় ঘেঁষে ডাম্পিং ইয়ার্ডে ট্যানারির কঠিন বর্জ্যগুলো (চামড়ার উচ্ছিষ্ট অংশ) স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি হলে এসব বর্জ্যের রাসায়নিক বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে সরাসরি চলে যায় নদীতে।

ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে শোধনের পর ইপিজেডের তরল বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয়। সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ইপিজেডে আছে মাত্র ৯২টি। যার মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ইটিপি রয়েছে। ল্যাবরেটরিতে নিয়মিত পানি পরীক্ষা করা হয়। ইপিজেড থেকে ক্ষতিকর বর্জ্য বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) দায়িত্বে থাকা ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কঠিন বর্জ্য ও সিইটিপি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তি করব।’

পাল্লা দিয়ে চলছে নদী দখল:

সাভার উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের ২০১৯ সালের নদী দখলদারদের তালিকা অনুসারে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা ১৩৪। এই তালিকায় রয়েছে সাভার থানা মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি, সাভার বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, আওয়ামী লীগ নেতা, জনপ্রতিনিধির নিজের ও তাদের সন্তানের নাম।

নদীর দুপাশের তীরঘেঁষে এর মাটি দিয়ে নদী ভরাট করে নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন আধা পাকা দোকান, বাড়ি, গুদাম, সাভার থানা মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন বহুমুখী সমিতি লিমিটেড, বালুর আড়তসহ নানা স্থাপনা।

বংশী নদের সাভার থানাঘাট থেকে শুরু করে নামাবাজার হয়ে বাঁশপট্টি পর্যন্ত এখন দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে। এই অংশের কয়েকটি পয়েন্টে ময়লা ফেলে নদীর জায়গা দখল করার চিত্র চোখে পরে। এসব নিয়ে পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করলেও কার্যত কোনো সুফল মিলছে না।

অন্যদিকে আশুলিয়ার নয়ারহাট ব্রীজের উত্তর দিকে বংশী নদী দখল করে গড়ে উঠেছে অন্তত ত্রিশটি বালুর গদি। এর আগে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পক্ষ থেকে বালুর গদিগুলো সড়িয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি রফিকুল ইসলাম ঠাণ্ডু মোল্লা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এক শ্রেণির প্রভাবশালী দেদারসে সাভারের নদী-নালা ও খাল দখল করে চলেছে। পাশাপাশি শিল্প কারখানার দূষণ তো রয়েছেই। নদী দখলের ব্যাপারে আমরা ইউএনও সাহেবকে বলেছি দখলদারদের যেই তালিকা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কি অ্যাকশন নিবেন?

তিনি জানিয়েছেন উচ্ছেদ পরিচালনা করতে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাজেট ও সহযোগিতা লাগবে। সে অনুযায়ী তিনি প্রস্তাবনা পাঠাবেন। সর্বোপরি প্রশাসন থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দখল বন্ধ হবে না।

সাভার থানা মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন বহুমুখী সমিতির নদী দখলের বিষয়টি প্রসঙ্গে সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাজহারুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, যে এলাকা পর্যন্ত ঘর নির্মাণাধীন, সে পর্যন্ত জায়গাটি খাস। তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন পাঠানো হয়েছে।

ইউএনও বলেন, নদী দখল করে বালুর গদি এবং দোকানঘর নির্মাণের খবর শুনে আমি সম্প্রতি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। কারা নদী দখল করেছে তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। খুব শিগগির অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

(ঢাকাটাইমস/০১অক্টোবর/এসএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :