শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় যেসব চাল

প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২২, ১১:৩৪ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২২, ১২:২২

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য হিসেবে চাল তথা ভাতের কদর ব্যাপক। বহুকাল আগে থেকেই বাঙালির খাদ্যতালিকায় প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে ভাত। ভাতের সঙ্গে বাঙালির এক আলাদা টান রয়েছে। ভাত হিসেবে গ্রহণযোগ্য চাল উৎপাদনকারী ধানের বয়স ৮ হাজার থেকে ১৩ হাজার বছর। কথিত আছে, বুনো প্রজাতির ধানকে প্রথম চাষের আওতায় আনা হয়েছিল চীনে। বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ অনুযায়ী, প্রথম ভাত খাওয়ার প্রচলন ঘটেছিল চীনের পার্ল উপত্যকায়। তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব এশিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।

সারা বছর দেশজুড়ে একমাত্র যে খাদ্য পাওয়া যায় তা হলো চাল। প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স) চালে শর্করা থাকে ৮০ গ্রাম, চিনি ০.১২ গ্রাম, ফাইবার ১.৩ মিলিগ্রাম, স্নেহ পদার্থ ০.৬৬ গ্রাম, প্রোটিন ৭.১৩ গ্রাম। ভিটামিনের মধ্যে রয়েছে- থায়ামিন (বি১) ০.০৭০১ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন (বি২) ০.০১৪৯ মিলিগ্রাম, ন্যায়াসেন (বি৪) ১.৬২ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) ১.০১৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন (বি৬) ০.১৬৪ মিলিগ্রাম। ধাতুর মধ্যে রয়েছে- ক্যালসিয়াম ২৮ মিলিগ্রাম, লোহা ০.৮০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ২৫ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ১.০৮৮ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১১৫ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১১৫ মিলিগ্রাম, দস্তা ১.০৯ মিলিগ্রাম। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে পানি ১১.৬১ গ্রাম। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ রকম উপকারী। বাজারে বিভিন্ন ধরনের চাল পাওয়া যায়। কিন্তু এ চালগুলোর মধ্যে কোনটি স্বাস্থ্যসম্মত এ নিয়ে অনেকের মাঝেই বিভ্রান্তি রয়েছে।

এমন কিছু চাল রয়েছে যা খেলে ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, ওবেসিটি, উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে। নিজের প্রয়োজন অনুসারে চাল বাছাই করে নিতে পারেন আপনি।

 

বাদামি চাল

সবচেয়ে পুরনো শস্য হলো বাদামি চাল। ধান ছাড়ানো হলে চালের যে অংশটি উন্মুক্ত হয় তা অনেকটা বাদামি রঙের। এই চাল আগে ঢেকি ছাঁটা চাল হিসেবেই বিক্রি করা হত। চালের পুষ্টিগুণের পুরোটা মেলে বাদামি চাল থেকে। এই চালের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার। প্রতি কাপ শুকনো চালে যে পরিমাণ ফাইবার থাকে তা সাদা চালের তুলনায় ১.৫ গ্রাম বেশি। বাদামি চাল যে ফাইবার থাকে তা অদ্রবণীয়। যা হজমের জন্য খুব ভাল। অন্ত্রের জন্যও ভাল।

 

সাদা চাল

চালের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো এই সাদা চাল। অনেকেই ঝকঝকে সাদা চাল খেতে পছন্দ করেন। এ চাল তাই বাজারে বেশ বিক্রি হয়। অধিকাংশ বাড়িতে, হোটেলে সাদা চালই ব্যবহার করা হয়। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার ন্যাশনালের মতে, সাদা চালে আলাদাভাবে যোগ করা হয় আয়রন, থায়ামিন, নিয়াসিন, ফলিক অ্যাসিড। তবে চালের প্রতি কাপে ক্যালোরির পরিমাণ ১৬০। স্বাভাবিক চালকে অনেক সময় ইউরিয়া কিংবা অন্য কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করে সাদা করা হয়।

 

কালো চাল

সাদা চাল, বাদামি চাল, লাল চাল ও কালো চাল- এই চার রকমের চালের মধ্যে কালো চালের গুণাগুণ আধুনিক পুষ্টিবিদদের নজর কেড়েছে। চিকিৎসা-সংক্রান্ত গুণাগুণের জন্য কালো চালকে ‘ওয়ার্ল্ড সুপার ফুড’ বলা হয়। ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম পরিচিতি লাভ শুরু করে কালো চাল। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে যেমন, চিন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে এই চালের চাষ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এই চালের বহিরাংশে অ্যান্থোসায়ানিন বেশি মাত্রায় উপস্থিত থাকায় চালের রঙ কালো হয়। কৃষিবিজ্ঞানীরা চার রকমের কালো চালের খোঁজ পেয়েছেন। এগুলো হল ব্ল্যাক জাপনিকা চাল, ব্ল্যাক গ্লুটিনউস চাল, ইতালিয়ান কালো চাল ও থাই ব্ল্যাক জেসমিন চাল। হাফ কাপ কালো চালের পুষ্টিগুণ বিচার করলে দেখা যায় এতে শক্তি আছে ৩৫৬ কিলো ক্যালোরি, প্রোটিন ৮.৮৯ গ্রাম, ফ্যাট ৩.৩৩ গ্রাম, শর্করা ৭৫.৫৬ গ্রাম, ফাইবার ২.২ গ্রাম, আয়রন ২.৪ মিলিগ্রাম।

কালো চালে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রচুর থাকায় শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ত্বক পরিষ্কার করে ও শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। কালো চাল শরীরের প্রদাহ কমায় ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। এতে থাকা ফাইবার হার্টকে সুস্থ রাখে। গবেষণায় জানা গেছে, কালো চাল নিয়মিত খেলে সংবহন তন্ত্রে এথেরসক্লেরো টিক প্লাক তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে শিরা-ধমনির ভেতরে ফ্যাট জমে না ও রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। এমনকী, এই চাল ক্যানসারও প্রতিরোধ করে। কালো চাল হজমেও সাহায্য করে। এই চালে প্রচুর ভিটামিন বি থাকায় মানসিক চাপ কমায় ও স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে।

 

লাল চাল

দেখতেই  লাল, তবে এই চাল কিন্তু বেশ মিষ্টিও। এই চালের মধ্যে মিষ্টি আর নোনতা দুই স্বাদই থাকে। বলা হয় লিউকোমিয়া, সার্ভিক্যাল ও কোলন ক্যানসার রুখতে সাহায্য করে। এই চালের মধ্যে রয়েছে প্রোঅ্যান্থোসায়ানিডিন। যা মূলত ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়। জার্নাল অফ এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ফুড কেমিস্ট্রিতে ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, লাল চালের অ্যান্টিডায়াবেটিক প্রভাব রয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লাল চালের তুষের নির্যাসের সংস্পর্শে আসার সাথে বেসাল গ্লুকোজ (রক্ত শর্করার সঠিক নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ) ২.৩ থেকে ২.৭-গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই লাল চালে টোকোট্রিয়েনল রয়েছে যা মূলত ভিটামিন ই। নিউরোপ্রোটেকশন, অ্যান্টি-ক্যাসার এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের খোসার লাল রংটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে। আর এটি ফেলে না দিয়ে খাদ্যে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করাই ভালো।

 

বাসমতী চাল

স্বাদে ও গন্ধে চালের দুনিয়ায় সেরার সেরা স্বাস্থ্যকর বাসমতি চাল। অন্য যে কোনো চালের থেকে, বাসমতি চালে ২০% বেশি ফাইবার থাকে। এছাড়াও বাসমতি চালের গ্লাইসেমিক সূচক, কম থেকে মাঝারি মাত্রার। শরীরে এনার্জি বজায় রাখতে এর তুলনা নেই। বাসমতী চালের ভাত দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ সবল রাখতে সাহায্য করে। দেশের যে কোনও জায়গায় পাওয়া যায় এই চাল এবং দামও আয়ত্তের বাইরে নয়।

 

জেসমিন চাল

দুর্দান্ত স্বাদ এবং স্বাস্থ্যগুণের জন্য খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে জেসমিন চাল। এখন বহু রেস্তোরাঁয় পাওয়া যাচ্ছে এই চালের ভাত। প্রচুর পরিমাণ অ্যামিনো অ্যাসিড থাকায় মস্তিষ্কের জন্য উপকারী এটি। শরীরে বিষক্রিয়া ঠেকাতেও এর জবাব নেই।

 

আঠালো চাল

সাদা ভাতের মতো জনপ্রিয় নয় এই চালের ভাত। এতে উপস্থিত তামা এর অণুগুলোকে একসঙ্গে ধরে রাখে তাই এই চালের ভাত আঠালো প্রকৃতির হয়। বেশ দামি এই চাল খুব একটা সুলভ নয়, তবে ভাত বানাতে একেবারে কম সময় লাগে। সবথেকে বড় কথা, অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

 

সতর্কতা

বাজারের সব চালই ভালো নয়। বাড়তি দামের আশায় অনেক বিক্রেতা চালে লাল, কালো বা বিভিন্ন রং মেশাতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার খেয়াল রাখতে হবে চাল থেকে রং উঠছে কি না। চালের প্রাকৃতিক যে বাদামি বা লাল, কালো রং তা পানিতে ধুলেও সাধারণত উঠবে না (উঠলেও অতি সামান্য)। অন্যদিকে দোকানি যদি বাড়তি রং প্রয়োগ করে তাহলে তা ধোয়ার সময় বোঝা যাবে। এছাড়া মিনিকেট এবং নাজিরশাইল নামের কোনো ধান বাংলাদেশে চাষ হয় না। মুনাফার লোভে মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করছেন মিলমালিকরা। যে প্রক্রিয়ায় মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে কম দামের চাল বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

(ঢাকাটাইমস/০২ অক্টোবর/আরজেড)