মাঠে মারা গেছে তালগাছ প্রকল্প, বজ্রপাত ঠেকাতে কী করবে সরকার

প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০২২, ১০:০৩ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২২, ১১:৩৯

মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকাটাইমস

দেশে ২০১৬ সালের পর থেকেই অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে ২০১৭ সালে সারাদেশে রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা-আঁটি রোপণের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্দেশের পর কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় তালগাছের চারা-আঁটি লাগানোর উদ্যোগ নেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।

সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক কোটি তালগাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর পর দেখা গেল যত্নের অভাবে গাছগুলোর বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। সে কারণে আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এটা বাতিল করে দিয়েছি।

কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় লাগানো তাল গাছগুলো কোনো কাজে আসেনি। বেশিরভাগ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। যদিও তালগাছের চারা রোপণের মাধ্যমে সরকারের কত কোটি টাকা গচ্চা গেছে তার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অদিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক রবিবার ঢাকা টাইমসকে জানান, মূলত তালগাছ লাগানোর জন্য আলাদা কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এটা কাবিখা প্রকল্পের আওতায় নতুন রাস্তায় তালগাছ লাগানোর শর্ত দিয়ে কাজ করানো হয়।

অভিযোগ রয়েছে, কাবিখা প্রকল্পের আওতার মধ্যেই গাছ লাগাতে গিয়ে শতকোটি টাকা লোপাট হয়েছে। কাগজে কলমে ৩৮ লাখ গাছ লাগানোর হিসাব থাকলেও এখন বেশিরভাগ গাছের হদিস মিলছে না।

দেশে বজ্রপাতের প্রবণতা ও মৃত্যুহার বিবেচনা করে ২০১৬ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে বজ্রপাত হতে পারে দেশের এমন হটস্পটগুলোতে বজ্র নিরোধক দণ্ড বসিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। সেজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালে বজ্রপাতে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন ও ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৩৬ জন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২১৬ জনের বেশি মানুষ প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে মৃত্যুবরণ করেছে। আর ২০২১ সালে বজ্রপাতে অন্তত ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

চলতি বছরে ২০২২ সালে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫৮ জনের বজ্রপাতে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান তাল গাছ লাগানোর পরিকল্পনা বাতিলের বিষয়ে বলেন, ‘একটা তালগাছ উঁচু হতে ৩০-৪০, ৫০ বছর লাগে। বজ্রপাত প্রতিরোধে এটা ততোটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। এখন বজ্রপাত প্রতিরোধে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রবর্তন হয়েছে। আমরা সেটাকেই এখন আমাদের দেশে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’

বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে আশ্রয়কেন্দ্র ও লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে সচেতনতা প্রচারণা ও আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম চালু করব। ৪০ মিনিট আগেই মোবাইল অ্যাপে সতর্ক করতে পারবে। খোলা জায়গায় যারা থাকবে তাদের জন্য ছোট করে লাইটনিং সেন্টার ও লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপন করা হবে। ডিপিপি অনুমোদন হলে শুরু করবো। পরীক্ষামূলকভাবে ৪০টি বসিয়েছি।’

প্রতিমন্ত্রী জানান, আসন্ন বাজেটে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

কাবিখা পরিকল্পনায় তালগাছ লাগানোর বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক ঢাকা টাইমসকে আরও বলেন, ‘প্রতিবছর যে আলাদা নতুন রাস্তা করা হয় সেসময় তালগাছ লাগানোর শর্ত দেওয়া হয়েছিল। আমরা যখন বরাদ্দ দিই তখন বলে দেয়া হয়, এতোগুলো তালের চারা রোপণ করতে হবে।’

সেমসয় শুধু গাছ লাগানোর জন্য যে বলা হয় সেখানে টাকার পরিমাণ উল্লেখ থাকে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা মূল বরাদ্দ থেকে দেওয়া হয়। কাবিখার কাজগুলোতে ওয়েজ এবং ননওয়েজ খরচ আছে। প্রত্যেক জায়গাতেই কাগজপত্র কেনা, মাস্টাররোল করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই ননওয়েজ খরচের মধ্যে গাছ লাগানোর খরচ থাকে।’

এদিকে কয়েকদিনের টানা গরমের পর হঠাৎ রবিবার ভোরে আকাশে মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝলকানি আর বিকট বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভাঙে রাজধানীবাসীর। তবে এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়েছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছে। আর এতে বজ্রপাতের তীব্রতাও বেড়ে গেছে।’

বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার উপায়

ভূপৃষ্ঠের পানি যখন বাষ্প হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে তখন মেঘের নিচের দিকে ভারী অংশের সঙ্গে জলীয়বাষ্পের সংঘর্ষ হয়। এর ফলে অনেক জলকণা ইলেকট্রন ত্যাগকৃত হয়ে ধনাত্মক চার্জে পরিণত হয়। আবার অনেক জলকণা সে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়। চার্জ হওয়া জলীয়বাষ্প মেঘে পরিণত হলে মেঘে বিপুল পরিমাণ স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয়। এসময় অপেক্ষাকৃত হালকা ধনাত্মক আধান মেঘের ওপরে ও অপেক্ষাকৃত ভারী ঋণাত্মক চার্জ নিচে অবস্থান করে। মেঘে এই দুই বিপরীত চার্জ যথেষ্ট পরিমাণে হলে ডিসচার্জ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ডিসচার্জিংয়ের ফলে বাতাসের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক প্রবাহিত হয়। এ বৈদ্যুতিক স্পার্কের প্রবাহই বজ্রপাত।

বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে না থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকুন। যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকুন। কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকুন। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না; সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। এ সময়ে বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকুন।

এছাড়া বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করবেন না। জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে পারেন। বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন।

তারা পরামর্শ দিয়ে আরও বলেন, বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাবেন না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। প্রতিটি বিল্ডিং-এ বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করুন। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না-থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান। বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্রাহত ব্যক্তির শাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/০৩অক্টোবর/এফএ)