পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করাটাই বড় পাপ মনে হচ্ছে: রাজীব কর

প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০২২, ২০:৩০ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২২, ২১:৫৭

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

সারাদেশে ২০১৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত  নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে  পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি মামলায় নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা চেপে যান বা আপস করে ফেলেন।

২০১৯ সালে রাজধানীর কোতওয়ালী থানা পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন রাজীব কর রাজু নামের স্বর্ণের দোকানের কর্মী। তিনি ঢাকাটাইমসের সঙ্গে সোমবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে আলাপকালে বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আমি বড় একটি পাপ করেছি। সারাক্ষণ জীবনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক আমি  এই মামলা তুলব না।’

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা করেছেন রাজীব কর। এছাড়াও তিনি প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশ সদর দপ্তরেও লিখিত অভিযোগ করেছেন। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তরকে চিঠি দেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এতে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু এখনও কোনো  চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি।

চলতি বছরের ২ মার্চ রাজীব করের করা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন কোতোয়ালি থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান (৪০), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ফরিদ ভূঁইয়া (৩৫) ও এসআই জলিল (৩৫)। মহানগর দায়রা জজ আদালতের নির্দেশে এই মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ঘটনায় তাদেরকে প্রত্যাহার করা হয়। 

রাজীব করের অভিযোগ:  রাজীব কর একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করতেন। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে এসআই মিজানুর রহমান ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়া রাজধানীর গোয়ালনগরের বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যান। এক রাতে তিনি নির্যাতনে তিনবার জ্ঞান হারান। প্রথমে তাকে ব্যাট দিয়ে পেটায়, বুট দিয়ে মুখ মাড়িয়ে দেয় ও প্লাস দিয়ে নখ তুলে নেয়। সবশেষে উলঙ্গ করে পুরুষাঙ্গে বৈদ্যুতের শক দেয়।

রাজীব করের অভিযোগ, তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সদস্যরা বাসা থেকে তার স্ত্রী ও মায়ের ২৮ ভরি সোনা, মায়ের চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য রাখা ৪১ হাজার ৩০০ টাকা, মোবাইল, ল্যাপটপ ও ব্যাগে রাখা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যান। পরদিন পরিবারের সদস্যরা দুই লাখ টাকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।

ঘটনার পর বছরখানেক অসুস্থতার কারণে রাজীব কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়ে চিঠি দেন। তবে ঢাকায় আর পাকাপাকিভাবে ফিরতে পারেননি। এখন পর্যন্ত তিনি স্বর্ণালংকার ও টাকা ফেরত পাননি।

পুলিশ কীভাবে হুমকি দিচ্ছে, জানতে চাইলে রাজীব কর বলেন, তার এই অভিযোগ পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, পুলিশের ওয়ারী বিভাগ ও রাঙামাটি জেলা পুলিশ তদন্ত করেছে। এখন করছে পিবিআই। তদন্ত চলার সময়ই এসআই মিজানুর তাকে বলেন, এত হাঙ্গামা হবে জানলে আর রাজীবকে বাঁচিয়ে রাখতেন না। পিবিআই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে, রাজীব করও সঙ্গে যান। তখন স্থানীয় লোকজন বলেন, পুলিশ নিয়মিত তার খোঁজে বাসায় যায়। দুটি মুঠোফোন নম্বর থেকেও ফোন করে মিটমাট করার জন্য জোরাজুরি করা হচ্ছে। পুলিশ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে এমনও বলা হচ্ছে।

রাজীব কর ঢাকাটাইমসকে বলেন, তাকে নির্যাতনের খবর জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে গুজব রটানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তিনি ভারতীয় এক নাগরিকের কাছ থেকে সোনা কেড়ে নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই নাগরিককে পুলিশ হাজির করতে পারেননি। এমনকি পুলিশ তার নামে কোনো মামলাও করেনি। কেন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, সে সম্পর্কে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মিজানুর রহমানসহ অন্য পুলিশ সদস্যদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও সেসব নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

ভয়াল রাত :  সেই রাতের কথা মনে করে রাজীব কর ঢাকাটাইমসকে বলেন, 'আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ আমাকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করেন।' নির্যাতন সইতে না পেরে কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারান তিনি। 'পরে এএসআই ফরিদ ও এসআই জলিল আমাকে আবারও নির্যাতন করে। আমাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারা আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসা শেষে আবার নিয়ে যায় থানায়। তারপর বাসায় ফোন করার জন্য তারা আমার ফোন ফিরিয়ে দেয়।' দুই লাখ টাকা দেওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। অ্যাকাউন্টের টাকা লেনদেন স্লিপ এখনও তার কাছে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

কেন পুলিশ তাকে টার্গেট করেছে এই ব্যাপারে নিশ্চিত নন রাজীব। 'মামলা করার পর পুলিশের কিছু কর্মকর্তা বলার চেষ্টা করেছেন যে, আমি নাকি একজন ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে সোনা ছিনিয়ে নিয়েছি। এইজন্য তারা আমাকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তারা এখনও পর্যন্ত কোনো ভুক্তভোগীকে আমার সামনে হাজির করতে পারেননি।

রাজীবের মামলা করার পর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন আদালত। ১৮ মে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপাতালের রেজিস্ট্রার বইতে প্রমাণ আছে যে, রাজীবকে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাকে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। ওই দিনই ইনজুরি সার্টিফিকেট দেয় হাসপাতাল। নথি অনুসারে, রাজীবের উপরের ও নিচের ঠোঁটে, ডানদিকের তর্জনী এবং অনামিকাতে আঘাত ছিল। তার পিঠে ও উভয় বাহুতে আঘাতে কালচে দাগ ছিল।

রাজীব কর ঢাকাটাইমসকে বলেন, 'যদি জানতাম পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার পর আমাকে এতো ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তাহলে আমি মামলা করতাম না,' রাজীব হতাশার সুরে বলেন। 'এখন ভবিষ্যত নিয়ে ভয় পাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।  শুনেছি এই ঘটনায় তৎকালী কোতওয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবিএম মশিউর রহমান, উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান,আবদুল জলিল এবং সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ফরিদর ভূঁইয়াকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

নির্যাতনের শিকার রাজীব করের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর থানার চৈনপুর গ্রামে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার তদন্দকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কুতুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ওই মামলাটি এখন তদন্তাধীন রয়েছে। রাজিব করের বিরুদ্ধে ভারতীয় নাগরিক এক হিন্দু ধর্মের লোক অভিযোগ করেছিলেন। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই তাকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। আমি ওই অভিযোগের কপিও পেয়েছি। যাইহোক এই মামলার  তদন্ত শেষের দিকের রয়েছে। আমরা দ্রুত প্রতিবেদন দিয়ে দিবো।

(ঢাকাটাইমস/০৩ অক্টোবর/এএ/)