ব্যবসা পরিচালনায় সেবা পেতে ঘাটে ঘাটে ঘুষ

প্রকাশ | ০৪ অক্টোবর ২০২২, ০৭:৪৮ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১৩:৪৩

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস

ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ঘুষ দিতে হয় ঘাটে ঘাটে। প্রতিবাদ করলে পড়তে হয় নানামুখী হয়রানিতে। উপরি না দিলে বন্দর থেকেও পণ্য খালাস হয় না। নানা অজুহাতে আদায় করা হচ্ছে ঘুষ। কাস্টমসসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। গ্যাস, বিদ্যুৎসহ প্রায় সব সেবা খাতেই ঘুষ দিয়ে সেবা নিতে হচ্ছে। কাগজে লেখা থাকে না- এরকম ব্যয়কে ব্যবসা পরিচালনায় বড় বাধা বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীর।

দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর বেশ কয়েকজন নেতা ঢাকা টাইমসের সাথে আলাপকালে এমন অভিযোগ করেন। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা।

এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক যে ২৫টি টিম গঠন করেছিল, সেগুলো এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ফলে দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির গতি সঞ্চার করতে যাদের ভূমিকা অন্যতম, সেই শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ঘুষ ও হয়রানির শিকার হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এই হয়রানি বন্ধে সরকারকে শক্ত অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে জরুরি ভিত্তিতে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। দেশে প্রচলিত যে আইন রয়েছে তা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট। তবে এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কারণ, ব্যবসা কার্যক্রম না এগোলে দেশ পিছিয়ে যাবে।’

সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৯ শতাংশ পোশাক কারখানাকে ঘুষ দিতে হচ্ছে। আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা পেতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে ৭০.৯ শতাংশ পরিবার। এর মধ্যে হয়রানির ভয়ে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করে না। আর ১৯ শতাংশ অভিযোগ করে থাকেন। এসব অভিযোগের মধ্যে ৭২ শতাংশের ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দেশের পোশাক উৎপাদন খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. নাসির উদ্দিন গতকাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঘুষ দিতে দিতে আমরা অতিষ্ঠ। যে অফিসেই কাজ নিয়ে, কাগজ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যান, সেখানেই দিতে হয় আইনবহির্ভূত টাকা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কাস্টমস থেকে শুরু করে ব্যবসা সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সরকারি দপ্তরে এই ঘুস আদায় ও হয়রানি বন্ধ না করলে ৬ মাসের মধ্যে আমরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবো।’ বিজিএমইএ’র এই নেতা আরও বলেন, ‘এসব কারণে ইতোমধ্যেই কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধের দ্বারপ্রান্তে। কারণ, এত পরিমাণ ঘুস দিতে হয় যে, ওই টাকা ব্যবসা করে সমন্বয় করা আমাদের পক্ষে এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।’

যদিও ঘুষ প্রদানের বিষয়ে তেমন একটা মুখ খুলতে দেখা যায় না ব্যবসায়ীদের। তবে পরিস্থিতি অতিরিক্ত অস্বস্তিকর হওয়ায় গত রবিবার রাজধানীর গুলশানে এক অনুষ্ঠানে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা মুখ খোলেন। অভিযোগ করেন ঘুষ ও হয়রানির। ওই অনুষ্ঠানে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন সেবা পেতে ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ তোলেন দেশের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এ রকম অপ্রদর্শিত ব্যয়ে ব্যবসা পরিচালনা কার্যক্রম কঠিন হয়ে উঠছে। কাস্টমস এবং বন্ড লাইসেন্সকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন তারা। ট্রেড লাইসেন্সসহ সব ধরনের সনদ এবং নিবন্ধন পেতেও দুর্ভোগের কথা বলেন তারা। বছর বছর নবায়নেও একই প্রতিবন্ধকতা। এতে ব্যবসা পরিচালনায় সময় ও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।

এফবিসিসিআই নেতার কাছে ঘুষ চাইল কাস্টমস

ওই অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই পরিচালক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘কাস্টমস এবং বন্ড লাইসেন্স এ মুহূর্তে দেশে ব্যবসা পরিচালনায় প্রধান প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। নিজের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো এক ঘটনায় কাস্টমস অ্যান্ড বন্ড কমিশনারেট অফিসের কর্মকর্তারা তার কাছে ঘুষ চান। এর প্রেক্ষাপটে এক কমিশনার বন্ধুর কাছে তিনি সহায়তা চান। এরপরও কর্মকর্তা বলেছেন, ‘উনি আপনার বন্ধু, আমরা তো নই। আমাদের ভাগেরটা দেন। বিজিএমইএর মতো বড় সংগঠনের নেতারা যদি ঘুষ দিতে পারে তাহলে আপনারা কেন পারবেন না।’

‘ডিরেক্টরের ভাগেরটা না দিলেও আমাদের ভাগ দিতে হবে’

নিট পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নারায়ণগঞ্জের বিসিক এলাকায় একটি কারখানার আমদানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি) সংক্রান্ত একটি অনুমতির জন্য তাদের এক সদস্য কারখানার কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। এরপর সংশ্নিষ্ট পরিচালককে ফোন করার পর তিনি ওই ফাইলে সাইন করে দেন। কিন্তু ওই অফিসের নিচের সারির কর্মকর্তারা বলেন, ‘ডিরেক্টরের ভাগেরটা না দিলেও আমাদের ভাগেরটা দিতে হবে।’ সেটা কত- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩০ হাজার টাকা। শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ওই কাজটি করাতে হয়েছে।

অপ্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট চেয়ে ঘুষ আদায়

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, স্থানীয় শিল্প কিংবা রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন, সব ক্ষেত্রেই লাইসেন্স পেতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। অপ্রয়োজনীয় অনেক ডকুমেন্ট দাবি করা হয় ঘুষ আদায়ের অসৎ উদ্দেশ্যে। যেগুলোর আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। এগুলো পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ব্যবসা কার্যক্রমকে সহযোগিতার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়।

ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, দেশে যেসব আইন, বিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেসব বিধিমালা রয়েছে তা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। ব্যতিক্রম হচ্ছে চুনোপুঁটির বেলায় এসব আইন প্রয়োগের দু-একটি ঘটনা। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে প্রভাবশালী চক্রের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয় না।’ তিনি বলেন, ‘আইন যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলকভাবে প্রয়োগ করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথাকথিত বিভাগীয় পদক্ষেপ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর ভূমিকা নিলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধে দুদক যে ২৫টি টিম গঠন করেছিল সেগুলোর অবস্থা সম্পর্কে সংস্থাটির মহাপরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘টিমগুলো যে লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল, তারা তাদের কাজ সম্পন্ন করেছে। এরই মধ্যে ১৬টি টিমের প্রতিবেদন সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাকি টিমগুলোর রিপোর্ট প্রস্তুত করা হচ্ছে।’

দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন-২)  মো. আবুল বাশার ও যুগ্মসচিব (কাস্টমস) সুরাইয়া পারভীন শেলীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি। ফলে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য) ড. আব্দুল মান্নান শিকদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ‘এ বিষয়ে কোনো কমেন্ট করব না’, বলেন ড. আব্দুল মান্নান।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি প্রকাশিত টিআইবির গবেষণা জরিপে বলা হয়, দেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বা পরিবার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আর ২০২১ সালে দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এর পরে রয়েছে-পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও ভূমিসেবা। এছাড়া ঘুষ নেওয়ার দিক থেকে তালিকার প্রথমে রয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এর পরে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিআরটিএ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমিসেবা ও বিচারিক সেবা।

(ঢাকাটাইমস/০৪অক্টোবর)