ক্ষতিকর কোন খাবার কতক্ষণ আয়ু কমিয়ে দেয়
প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১০:২২
মানুষের দীর্ঘায়ু লাভের আকাঙ্ক্ষা বহু পুরোনো। সুন্দর এই পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই দীর্ঘায়ু পেতে চান। দীর্ঘায়ু পেতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সুস্থ এবং ফিট থাকা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুস্থ ও ফিট থাকতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে তা হলো ডায়েট। কেউ যদি স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করে তবে সে সুস্থ ও ফিট থাকে, যেখানে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে স্থূলতা বাড়ে এবং শরীরে নানা রোগের সৃষ্টি হয়। মানুষের আয়ু ধীরে ধীরে হ্রাস পায় যখন রোগগুলো তাদের ঘিরে ধরে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কিছু খাবার আপনার আয়ু কমিয়ে দিতে পারে। কারণ, এসব খাবার খাওয়ার ফলে কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখে গেছে ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যালঝাইমার্স ও ডিমেনশিয়া যেসব খাবার খেলে বাড়ে সেসব খাবার আয়ু কমিয়ে দেয়।
নিয়মিত বার্গার-পিজ্জাসহ ফাস্ট ফুডজাতীয় মুখরোচক সব খাবার খেয়ে নিজের অজান্তেই ফুরিয়ে ফেলছেন আপনার আয়ু। এমনই তথ্য প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এসব খাবার কমিয়ে দেয় আয়ু।
গবেষণা মতে, হটডগ স্যান্ডউইচে যদি ৬১ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত মাংস থাকে, তা একজন ব্যক্তির জীবনের ৩৬ মিনিট কমিয়ে দিতে পারে। হটডগে উপস্থিত পলিউনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ফাইবার থাকলেও এটি জীবনের আয়ু ৩৬ মিনিট পর্যন্ত কমিয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে রেড এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে, কারণ এতে চর্বি এবং লবণ বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। আপনি যদি এগুলি পুরোপুরি খাওয়া বন্ধ করেন তবে আপনি আরও ৪ বছর বাঁচতে পারবেন।
ইনস্ট্যান্ট নুডুলস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এতে সোডিয়ামের মাত্রা বেশি থাকায় তা শরীরের ক্ষতি করে।
কর্নফ্লেক্সের মতো খাবার দিয়ে যারা রোজ নাস্তা করছেন তারাও রয়েছেন আয়ু কমে যাওয়ার ঝুঁকিতে। কারণ এতে থাকে অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি। অতিরিক্ত চিনি ডায়াবেটিসের আশঙ্কা বৃদ্ধি করে।
প্যাকেটজাত নাস্তা খাওয়াও শরীরের জন্য ভালো নয়। চিপস, চানাচুরে লবণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। আর তাতেই ক্ষতি হয় শরীরের।
চিনিতে কোনও পুষ্টিগুণ নেই। কিন্তু চিনি ক্যালোরিতে ভরপুর। পুষ্টিগুণহীন এই ক্যালোরিই নানা রকম রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্যানসার থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস বা কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার মতো নানা জটিল অসুখ দেখা দিতে পারে অতিরিক্ত চিনির কারণেই। আর তার ফলেই কমতে পারে আয়ু।
অতিরিক্ত লবণ খাওয়া হলে রক্তচাপ বৃদ্ধি, পেটে ক্যানসার, স্থূলতা এমনকি হাঁপানির সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত লবণ খাওয়া হলে হার্ট ও কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়ু কমতে পারে।
চিপস এবং অতিরিক্ত তেলের ভাজাভুজি— সবেতেই প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি রয়েছে। এগুলো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যা নানা রকমের জটিল অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়।
আমেরিকার ‘সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর এক সমীক্ষা বলছে, যারা নিয়মিত ধূমপান করেন, তাদের আয়ু ১০ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে। সুস্থ ভাবে দীর্ঘায়ু পাওয়ার জন্য ধূমপানের অভ্যাস গোড়াতেই ত্যাগ করতে হবে— এমনই পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য পুষ্টির সূচক বা হেনি ১৫টি খাদ্যের ঝুঁকির কারণ ও সেই খাদ্যগুলো তৈরির সঙ্গে পরিবেশগত বিষয়গুলিকে তুলে ধরেছেন। গবেষকরা জানিয়েছেন যে প্রক্রিয়াজাত মাংস, চিংড়িমাছ, গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস, শূকরের মাংস ও গ্রিনহাউসের সবজি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে পুষ্টিগত উপকারিতা রয়েছে যে খাদ্যগুলোতে সেগুলো হলো মাঠে ফলানো ফল এব সবজি, বাদাম, বিভিন্ন ধরনের শস্য এবং কম-পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে এমন সামুদ্রিক খাবার মানুষের স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নেচার ফুড জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাটি মানুষের সুস্থ জীবন-যাপন করার উদেশ্যে এই গবেষণা করেন। সেখানকার বিজ্ঞানীরা প্রায় ৬ হাজার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের খাবার, জলখাবার এবং পানীয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই খাবারের গবেষণায় প্রত্যেক খাবার পরিবেশনে প্রতি ৭৪ থেকে ৮০ মিনিটের মধ্যে ছিল। বলা হয়েছে, হট ডগ, শর্করা জাতীয় পানীয়, বার্গার এবং স্যান্ডউইচের মতো খাবার খেলে স্বাস্থ্যকর জীবন থেকে অকিকাংশ মিনিট হ্রাস হয়ে যাচ্ছে।
রিপোর্ট বলছে, হটডগ স্যান্ডউইচে উপস্থিত ৬১ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত মাংস যা একজন ব্যক্তির জীবনের ৩৬ মিনিটের মতো কমিয়ে দিতে পারে। হটডগ-এ উপস্থিত পলিউনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ফাইবারের উপকারিতা থাকলেও এটি আমাদের জীবনকে চূড়ান্ত মূল্যে ৩৬ মিনিট কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, ফল, নন-স্ট্যার্চি ও মিশ্র সবজি, রান্না করা শস্য ও এবং রেডি-টু-ইট সিরিয়ালগুলো শরীরের আয়ু বাড়াতে সবচেয়ে লাভজনক হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
গবেষকরা দেখেছেন যে একটি ৮৫ গ্রামের চিকেন উইংস খেলে মানুষের জীবন থেকে ৩.৩ মিনিট আয়ু কমে যায়, কারণ এই উইংসে উপস্থিত সোডিয়াম ও ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। অন্যদিকে একটি গরুর মাংসের হট ডগ পাউরুটির মধ্যে দিয়ে খেলে আপনার জীবনের আয়ুর ৩৬ মিনিট কমিয়ে দেবে। এর কারণ প্রক্রিয়াজাত মাংসের ক্ষতিকর প্রভাব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে পিৎজা খাওয়া একজন ব্যক্তির জীবনের প্রায় ১০ মিনিট শেষ করে দেয়। সফট ড্রিঙ্কস খেলে আপনার জীবন কমে যায় ১২ মিনিট ৪ সেকেন্ড।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব মানুষ তাদের খাদ্যতালিকায় রেড মিট এবং প্রক্রিয়াজাত মাংসের পরিবর্তে ডাল, সবুজ শাক-সবজি, বাদাম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করেন, তারা ১৩ বছর বেশি বাঁচতে পারেন। আরও বলা হয়েছিল যে একজন বয়স্ক ব্যক্তিও যদি এই খাবারগুলো তার খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন তবে তিনিও ৩ থেকে ৮ বছর বেশি বাঁচতে পারবেন।
মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, রেড এবং প্রক্রিয়াজাত মাংসের চেয়ে খাদ্যে আরও সিরিয়াল, লেবু এবং বাদাম যোগ করা জীবনকে দীর্ঘায়িত করার সর্বোত্তম উপায়। নরওয়েতে করা গবেষণা অনুসারে, বিদেশে বসবাসকারী লোকেরা তাদের খাদ্যতালিকায় খুব কম ড্রাই ফ্রুটস, লেবু, ফল এবং সবুজ শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করেন। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে যে খাবার রয়েছে, তাতে প্রচুর প্রক্রিয়াজাত ফুড বা তা থেকে তৈরি আইটেম, রেড মিট এবং দুগ্ধজাত খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়। এই ধরনের খাবার স্থূলতা, ডায়াবেটিস, ক্যানসারের মতো অনেক রোগের কারণ হতে পারে, যার কারণে আয়ু কমতে শুরু করে।
গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদেশে বসবাসকারী মানুষও যদি ভালো ডায়েট অনুসরণ করেন এবং খাদ্যতালিকায় সিরিয়াল, বিনস, সাইট্রাস ফল ও বাদাম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করেন, তাহলে যারা খারাপ ডায়েট গ্রহণ করেন তাদের তুলনায় তারা ১৩ বছর বেশি বাঁচতে পারেন।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০ বছর বয়সী ব্যক্তি যদি বিনস না খান তাহলে যদি তিনি পরবর্তীতে দিনে ২০০ গ্রাম বা এক বাটি ডাল খান, তবে তার জীবনকাল প্রায় ২.৫ বছর বাড়তে পারে। বিনসজাতীয় খাবারে ফ্যাট খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায়, তবে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ খুব বেশি পাওয়া যায়। অতএব, কেউ যদি তার বয়স বাড়াতে চায়, তাহলে তার প্রতিদিন প্রায় ২৫ গ্রাম বাদাম খাওয়া উচিত এবং প্রায় ২২৫ গ্রাম সিরিয়াল যেমন ওটমিল, ব্রাউন রাইস ইত্যাদি খাওয়া উচিত।
লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন ৮০০ গ্রাম নানা ধরনের ফল এবং সবজি খেলে দীর্ঘজীবী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
খাদ্যতালিকায় শাকসব্জি বেশি রাখলে ৮০ বছর বয়সের ব্যক্তির আয়ুও সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। খাদ্যের গুণমান উন্নত করলে দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং অকালমৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে দেবে।
সবুজ শাক-সবজি, হলুদ রংয়ের সবজি বিশেষ করে ক্যাপসিকাম এবং ফুলকপি-বাঁধাকপি জাতীয় সবজি খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর জন্য আপেল, নাশপাতি, লেবু জাতীয় ফল, সালাদ, সবুজ পাতার শাক বেশ কার্যকরী হতে পারে বলে একমতে উপনীত হয়েছেন গবেষকরা।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে কলা খাওয়া একজন ব্যক্তির আয়ু সাড়ে ১৩ মিনিটে বৃদ্ধি করে। টমেটো সাড়ে তিন মিনিটের বেশি জীবন বৃদ্ধি করে। অ্যাভোকাডো জীবন বাড়ায় ২ মিনিট ৪ সেকেন্ড। পুষ্টি এবং পরিবেশগত প্রভাব ছাড়াও, গবেষকরা স্বল্পমেয়াদী বিশ্ব উষ্ণায়ন দ্বারা খাবারের শ্রেণিবিন্যাস করেছেন।