দেশটা তো আমাদের সংসার

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১১:৪৪

মতিউর রহমান

‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগে প্রায় ১৩ বছর ধরে কাজ করছি। প্রমোশন কিংবা বদলিজনিত কারণে নতুন নতুন জেলায় যেতে হয়েছে। অষ্টম জেলা হিসাবে এখন কাজ করছি পঞ্চগড়ে। প্রতিবার বদলি হওয়ার সময় উৎফুল্ল এবং আনন্দিত হতাম আমি।

২০১৪ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুরে বদলির সময়ও আনন্দিত ছিলাম ভীষণ। কারণ বদলি হলে নতুন নতুন জায়গার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়, নতুন জেলা দেখা যায়, সে জেলার সংস্কৃতি কালচার, আবহাওয়া- জলবায়ু, প্রকৃতি মানুষ সবার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে কিছুদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।

মানব জীবন মাত্রই ধ্বংসশীল। প্রতিনিয়ত সময়গুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। একসময় ইচ্ছে ছিল চাকরিতে থাকাকালে ৬৪ জেলায় বদলি হয়ে কাজ করার। কিন্তু সরকারি চাকরিতে একটা রেওয়াজ আছে এক কর্মক্ষেত্রে মোটামুটি তিন বছর থাকা যায় অন্য কোনো ঝামেলা না হলে।

যাহোক নতুন কর্মস্থলে যোগদানের সময় তারিখটা গোপন রাখতাম। সাধারণত কাউকে জানতে দিতাম না যে, আমি কবে ওই জেলায় যোগদান করব। কারণ হলো আমি যোগদানের আগের সময়টা এনজয় করি ভীষণ। নিজের পরিচয় গোপন রেখে নতুন কর্মস্থলে যাওয়া, সেখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে দেওয়া, আশপাশের টং দোকানে বসে চা খাওয়া, আইনজীবী-মক্কেল-মুহুরি সবার সঙ্গে মেশার দারুণ সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইনি কখনো।

একবার যোগদান করে বিচার কাজ শুরু করে দিলে ওই জেলায় কম বেশি অনেকে চিনে যায়। ফলে ওই জেলার বিশেষ করে আদালতের হাল-হকিকত গোপনে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আর থাকে না (খলিফা ওমরের মতো রাতের আঁধারে প্রজাদের দুঃখ দেখে বেড়ানোর মতো যোগ্যতা তো আমাদের নেই)।

তো প্রতিটি জেলায় যোগদানের কমপক্ষে দু- একদিন আগে গিয়ে হাজির হতাম। কাউকে না জানিয়ে আগের দিন কোর্ট প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করে বেড়াই। কোর্টের পরিবেশ দেখি। আদালতের বিচার ব্যবস্থা, কোর্টের স্টাফ, পেশকার-পিওনদের সঙ্গে পরিচয়হীনভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। মামলা করতে কত টাকা লাগে আর অন্যান্য খরচাপাতি কেমন দিতে হয় এসব কিছু যাচাই করি।

তো একটা জেলায় যোগদান করতে গিয়ে আগের দিন আদালত প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করছি। আমাকে মক্কেল ভেবে এক মোহরার ডেকে নিয়ে যায় তার সিনিয়রের কাছে। আমিও বেচারা উদ্দেশ্য গোপন রেখে মক্কেল হয়েই কথা বলি উকিলের সঙ্গে। মামলা করতে কত খরচাপাতি লাগবে, ঘাটে ঘাটে কত টাকা দিতে হবে সব কিছুর বয়ান শুনে চলে যাই আদালতের পেশকারের কাছে। মামলার ফটোকপি নিতে কত টাকা লাগবে, মামলার তারিখ নিতে, নথি দেখতে কত টাকা খরচ হবে সবকিছুর বর্ণনা বৃত্তান্ত শুনি।

একবার একটা জেলায় যোগদান করতে গিয়ে আগের দিন আদালতের এজলাসে উকিলদের সঙ্গে বসার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোর্ট স্টাফ আর পুলিশের বাধার কারণে আইনজীবীর পোশাকবিহীন আমাকে ভিতরে বসতে দেয়নি ওরা।

দিনমান কোর্ট কাচারিতে ঘুরে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে রুমে গিয়ে আমার কাজের পরিকল্পনা করি আমার মতো। এই পরিবেশে আমার কী করা উচিত, কী করতে হবে, কীভাবে কাজ করলে মোটামুটি পরিবেশ পরিস্থিতি সবকিছু আমার মতো করে গুছিয়ে নিতে পারবো, কী কী পদক্ষেপ নিলে বিচারপ্রার্থী মানুষকে হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে ইত্যাদি। সবকিছু একটা ছক একে এক বছরের পরিকল্পনা করে নিয়ে পরের দিন বেশভূষা চেঞ্জ করে রিকশায় চড়ে সরাসরি আদালতে গিয়ে হাজির হই আমি।

আদালতে প্রবেশ করে পিওনকে আমার পরিচয় দিতেই সে অবাক তাকায় আমার দিকে। ভালো করে দেখে তারপর ‘আসেন স্যার’ বলে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসতে দেয়। এরপর যাই যোগদান করতে। জেলা জজ স্যার হঠাৎ করে আমাকে দেখে কীভাবে এসেছি, কোথায় ছিলাম ইত্যাদি জানতে চায়। বলে আগে জানালে ভালো হতো, স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম আপনাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করত, ইত্যাদি। আমি মনে মনে বলি গতকাল পরিচয়বিহীনভাবে যা কিছু করেছি আমি, যা কিছু দেখেছি, গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে এখানে আনলে সেটা আর করতে পারতাম না।

আমি মুসাফির মানুষ। গোটা দুনিয়াকে মুসাফিরখানা মনে হয়। ২০১০ সালে রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সময় পুরো জেলাকে কত আপন মনে হয়েছিল অথচ মাত্র আড়াই বছর পরে বদলি হওয়ার সময় বুঝতে পারলাম সত্যিই তো আমি মুসাফির। রংপুর থেকে নীলফামারিতে গিয়েও সেখানকার মাটি মানুষ, আইন আদালত, পরিবেশ প্রকৃতিকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। ঠিক দুই বছর পরে সব ছেড়েছুড়ে আবার মেহেরপুর যেতে হয়েছিল।

মেহেরপুরের হাজারো স্মৃতি এখনো জমা আছে মানস পটে। কখনই ভাবিনি মেহেরপুর ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে। অথচ দুই বছর পরে ঠিক মেহেরপুর ছেড়ে আবার রংপুরে আসতে হয়েছিল। রংপুর থেকে নাটোর… এভাবে চলছে। এক সময় এ চলা থেমে যাবে। ভূপৃষ্ঠের মানুষগুলো আমরা এভাবেই ভূগর্ভে আমাদের মোটামুটি একটা স্থায়ী ঠিকানায় চলে যাই।

প্রসঙ্গক্রমে রবিউল স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। রবিউল স্যার মানে রবিউল হাসান স্যার। তিনি ২০০৭ সালে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন। বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর ২০০৭ সালে প্রথম বার পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঢাকা কলেজে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। পরের বছরও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি।

কিশোরগঞ্জের বিচারক থেকে রংপুরের স্পেশাল জেলা জজ হিসেবে বদলি হওয়ার সময় তার একান্ত সান্নিধ্যে ছিলাম আমি। ঢাকা থেকে রংপুরে এসেছেন স্পেশাল জেলা জজ হিসাবে যোগদান করতে, অথচ আদালতে তার কোনো কর্মচারীকে বিষয়টি জানতে দেননি তিনি। বাস থেকে টার্মিনালে নেমে রিকশা নিয়ে সোজা আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে হাজির হয়েছেন। কোর্ট-কাচারি, আদালত ফৌজদারি সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখে অফিসে গিয়ে হাজির হয়েছেন অচেনা অজানা মানুষের মতো। ওই সময় আমি রংপুরের বিচারক ছিলাম।

মেহেরপুরে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় রবিউল স্যার মেহেরপুরের জেলা জজ হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। স্যারের বদলির সংবাদ শুনে ফোনে আমি জানতে চেয়েছিলাম কবে যোগদান করবেন তিনি। বলেছিলেন সময় মতো অফিসে চলে আসবেন। ঠিক আমাদের কাউকে না জানতে দিয়ে হুট করে তিনি একদিন মেহেরপুরে চলে এসেছিলেন।

যোগদানের আগে অফিসের গাড়িতে চড়েননি কেন, এরকম প্রশ্ন করতেই স্যার বলতেন যে আমি তো এখনো জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব নিইনি। গাড়িতে চড়ি কীভাবে? তাছাড়া আমি তো এখানে যোগদান করতে আসার টিএ-ডিএ ভাতা পাব। আমি তো বিল করার সময় লিখব ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় সার্কিট হাউজে গিয়েছি এগুলো তা না হলে মিথ্যা হয়ে যাবে। স্যারের কাছে এসব শুনে অবাক হতাম আমি।

পরম শ্রদ্ধেয় হাসান শহীদ ফেরদৌস স্যারও আমার জেলা জজ ছিলেন। তিনিও যোগদান করতে আসেন রবিউল স্যারের মতোই। সরাসরি অফিসে এসে পিওনকে বলেন যে আমি এখানে জেলা জজ হিসাবে কাজ করতে এসেছি দরজাটা খুলে দেন। তারপর দরজা খুলে দিয়ে পিওন নাজির, নেজারতসহ হাঁকডাক করে অন্যান্য বিচারককে ডেকে নিয়ে যায়।

হাসান শহিদ ফেরদৌস স্যারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কেটেছে আমার। উত্তরাঞ্চলের কমবেশি প্রতিটি জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছি স্যারের সঙ্গে। স্যারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এবং সখ্য দেখে অনেকে সন্দেহজনক বিভিন্ন কথা বলেছিল আমাকে আর স্যারকে নিয়ে। একবার স্যার যোগদান করতে আসলেন অন্য একটি জেলায়। বিচারকরা ফুলের আয়োজন করল। স্যারকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিতে চাইলে স্যার সেই ফুল নেননি। বিনয়ের সঙ্গে বললেন এসব ফুল নষ্ট করার কোনো মানে হয়? কত মৌমাছির খাবার ছিল এখানে! তাছাড়া গাছে থাকলে ফুলগুলো অনেক দিন তরতাজা থেকে গন্ধ বিলাতে পারতো। স্যারের কথাগুলো এখনো কানে বাজে আমার।

দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে অন্যান্য দ্রব্যমূল্যও। বিদ্যুৎ সংকট আছে। নানা দিক বিবেচনায় অপচয় রোধ ও কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে সকাল আটটা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত অফিস সময় করা নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত হয়েছে। দেশটাকে আসলে একটা পরিবার মনে হয় আমার। জ্বালানি তেল যাতে সাশ্রয় হয় সেজন্য অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে চড়ি না আমি। অফিসেও যাই প্রায় সময় হেঁটে হেঁটে। খাস কামরায় অনেক লাইটের মধ্যে কখনো কখনো একটি লাইট জ্বালাই। বেশিরভাগ সময় লাইট জ্বালানো থেকে বিরত থাকি। দুটি ফ্যানের মধ্যে চালাই একটি ফ্যান।

মনে মনে ভাবি সকালে বা বিকালে এর ওর চেম্বারে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করার কি দরকার! সংসারের প্রতি দরদী ছেলেমেয়েরা পিতা-মাতার দুঃখ বোঝে। অভাবের সময় সংসারের অভাবগুলোকে অনুভব করে অল্পতেই তুষ্ট থাকার চেষ্টা করে। দেশটাও তো আমাদের সংসার। চেষ্টা করি কাজগুলো তিনটার মধ্যে শেষ করে অফিসের লাইট-ফ্যান বন্ধ করে বাড়িতে চলে আসার। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে মনে মনে দশবার বলি দেশটা তো আমাদের সংসার…"

লেখক: অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পঞ্চগড়