ইউক্রেনের ভূমি পুনর্দখল, সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতার মুখে পুতিন

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১৬:২৭

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

সম্প্রতি ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সাফল্যের সঙ্গে দখল হয়ে যাওয়া নিজেদের বেশ কিছু অঞ্চল পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে দেখা গেছে। গত সপ্তাহে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঞ্চল রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে পুতিনের সাফল্য দেখা গেলেও সামগ্রিক যুদ্ধে বিপর্যয়ের চিত্রই বেশি লক্ষণীয়।

কিছুদিন আগে পুতিন এক ভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলেন, রিজার্ভ থাকা সেনা মোতায়েন করে ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রের গতিশীলতা পরিবর্তন করতে পারবেন। কিন্তু ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণাত্মক অগ্রগতির কারণে তিনি বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে গণভোটের আয়োজন করে ইউক্রেনের চার অঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তিকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি দিয়ে কেবলই অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্র থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু ব্যাপক আকারে প্রচার করা মস্কোর সেই রাজনৈতিক কূটকৌশলগুলি ইউক্রেন যুদ্ধে বাস্তবতার আলো দেখেনি। বরং রাশিয়ার বাহিনী বিপর্যস্ত এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত হয়েছে।

সামরিক বিশ্লেষকরা অন্তত এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, রিজার্ভে থাকা ৩ লাখ রাশিয়ান সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পুতিনকে তেমন একটা সাফল্য এনে দিতে পারবে না। পুতিনের এমন চিন্তা মস্কোকে যুদ্ধক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এনে দিতে পারবে কিনা এটিই এখন দেখার বিষয়।

নতুন সৈন্যদের প্রভাব আংশিকভাবে নির্ভর করে তাদের কার্যকরভাবে প্রশিক্ষিত করা যায় কিনা এবং কীভাবে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী তাদের সংগঠিত করে এবং মোতায়েন করে তার ওপর।

আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সমালোচনামূলক-হুমকি প্রকল্পের সিনিয়র ফেলো এবং পরিচালক ফ্রেডরিক কাগান বলেছেন, ‘মানুষ মটরশুটি নয়। একটি মানচিত্রে ছাড়া ইউনিটগুলি একক নয়। আপনি যদি একগুচ্ছ ক্ষুব্ধ, নিরাশ, ভীত, অপ্রশিক্ষিত মানুষকে নিয়ে যান, তাদের অস্ত্র দেন এবং যুদ্ধ বাহিনীতে মোতায়েন করেন তার মানে আপনার হাতে সৈন্য নেই।’

কাগান আরও বলেন, পুতিনকে প্রথমে একটি সামরিক বাহিনীর মৌলিক যুদ্ধের সক্ষমতা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং বাজেভাবে বিধ্বস্ত ইউনিটগুলিকে স্কেলে পুনরায় সজ্জিত করতে হবে, যা অন্তত কঠিন।

শক্তিবৃদ্ধি করার আগে রাশিয়ানরা কতটা ভূখণ্ড হারাবে তা পুরোপুরি মস্কোর হাতে নেই। কেননা, ইউক্রেন এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দুটি প্রধান ফ্রন্টে রাশিয়ানদের প্রতিহত করে আসছে। তবে ইউক্রেনের বাহিনী কতদিন এই ধাক্কা সামলে রাখতে পারবে এটাও নিশ্চিত নয়।

সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো ক্রিস্টোফার ডোহার্টি বলেন, ‘কখন থামতে হবে তা জানা সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলির মধ্যে একটি। যেমন আপনি এই বিশাল লাভ করেছেন, আপনার সমস্ত লজিস্টিক্যাল লাইন প্রসারিত করেছেন এবং অনেক লোক শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করছে। জেতা এবং আক্রমণাত্মক হওয়ার ফলে আপনি মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা পাবেন, কিন্তু প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো সময় তেজ ফুরিয়ে যায়।’

সাম্প্রতিক সময় দেখা গেছে, ইউক্রেন তার গতি বজায় রেখছে। লাইমান শহরকে তারা সদ্য পুনরুদ্ধার করেছে এবং লুহানস্ক অঞ্চলের অধিকৃত এলাকার আরও গভীরে অগ্রসর হচ্ছে। পাশাপাশি দক্ষিণে ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ বেড়েছে, বাহিনী ডেনিপার নদী থেকে খেরসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কোথায় এবং কখন ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ শেষ পর্যন্ত থামবে তা অস্ত্র এবং গোলাবারুদের ওপর নির্ভর করবে। এসবের বেশিরভাগই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

মঙ্গলবার বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনে আরও চারটি হিমারস রকেট লঞ্চার, ১৬টি ১৫৫-মিমি হাউইটজার এবং ৭৫ হাজার ১৫৫-মিমি আর্টিলারি রাউন্ডসহ ইউক্রেনের জন্য অতিরিক্ত ৬২৫ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা ঘোষণা করেছে। ইউক্রেন দূরপাল্লার রকেট এবং ট্যাংক চেয়েছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেগুলি তারা পায়নি। হোয়াইট হাউসের মতে, ২৪ ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে ১৬.৮ বিলিয়ন নিরাপত্তা সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা যদি ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া অব্যাহত রাখে তবে অস্ত্রের প্রবাহকে ব্যাহত করার বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, কিয়েভকে দেওয়া আমেরিকান অস্ত্রের পরিমাণ ‘বিপজ্জনক সীমায়’ পৌঁছেছে।

প্রাথমিকভাবে টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে, কখনো কখনো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনেও যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কোর অবস্থান সম্পর্কে হতাশা রাশিয়ার জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

রাশিয়ান সামরিক ব্লগার ম্যাক্সিম ফোমিন মঙ্গলবার টেলিগ্রামে আপলোড করা একটি ভিডিওতে বলেছেন, রাশিয়ান বাহিনীর সামনে পরিস্থিতি মৃদুভাবে বলতে গেলে খুব ভাল নয়। ইউক্রেনীয় প্রশ্নের নিষ্পত্তিমূলক সমাধান করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাহিনী নেই রাশিয়ার।

খসড়া সেনাদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদের অনেক ক্ষেত্রেই ফ্রন্টে পাঠানো হবে। কিন্তু তারা যথাযথ প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না। আপনি অপ্রস্তুত লোকদের নিয়ে লড়াই করতে পারেন, তবে এর জন্য বড় ক্ষতির মুখে পরতে হবে।

লুহানস্কের একজন রাশিয়া-সমর্থিত মিলিশিয়া কর্মকর্তা আন্দ্রেই মারোচকো রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন শো ‘৬০ মিনিট’-এ বলেছিলেন, ন্যাটো সমর্থিত ইউক্রেনীয়রা উচ্চতর যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দা সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে। তারা আক্ষরিক অর্থে অনলাইনে আমাদের গতিবিধি, আমাদের দুর্গের কাঠামোতে স্যাটেলাইটগুলি রিয়েল টাইমে দেখে। এটি তাদের কিছু বিশেষ সুবিধা দেয় এবং তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা আমাদের থেকে অনেক বেশি করে তোলে।’

তিনি আরও বলেছিলেন, রাশিয়ান পক্ষের বেশ কয়েকটি জায়গায় ইউক্রেনীয়দের চেয়ে কম বাহিনী ছিল।

আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে বড় ধরনের যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তার কোনো সমাধান হয়েছে বলে খুব কমই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কয়েক মাস ধরে তারা সম্মিলিত স্থল এবং বিমান আক্রমণ পরিচালনা করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে।

সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে রাশিয়ান অভিযানের কোনো কমান্ডার জনসমক্ষে আসেননি। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিন যুদ্ধক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত নিতে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করছেন। দুর্বল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাশিয়ার মধ্যে কট্টরপন্থীরা দেশটির জেনারেলদের প্রকাশ্যে আক্রমণ করেছে।

কিংস কলেজ লন্ডনের রুশ রাজনীতির অধ্যাপক স্যাম গ্রিন বলেছেন, ‘তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যা ঘটছে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য লোকদের একটি কারণ দিয়েছে। যখন আপনাকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে না, তখন আপনি টেলিভিশন থেকে খবর পেতে পারেন এবং টেলিভিশন আপনাকে অনেক কিছু বলবে না। এখন হঠাৎ করেই এটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

র‌্যান্ড কর্পোরেশনের একজন সিনিয়র নীতি গবেষক দারা ম্যাসিকট বলেছেন, রাশিয়া কীভাবে খসড়াদের প্রশিক্ষণ ও মোতায়েন করতে চায় সে সম্পর্কে খুব কম নির্ভরযোগ্য জনসাধারণের তথ্য রয়েছে। এটি ঠিক কী ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে তা বলা খুব দ্রুত অনুমান করা যায়। এমনও হতে পারে তাদেরকে সামনের সারিতে রাখা হবে যাতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বহরে অনেক সেনা রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/০৫অক্টোবর/এসএটি)