‘দুইদিন আগে ব্যাটা কইল ‘মা মুই ভালো আছো’

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২২, ২১:২৭

আব্দুর রশিদ শাহ্, নীলফামারী

মধ্য আফ্রিকায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে চলছে মাতম।

ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক বাবা-মা আর থামানো যাচ্ছে না স্ত্রী শিমু আকতারের কান্না।

বুধবার সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক জাহাঙ্গীর আলমের ডিমলা উপজেলার ডিমলা ইউনিয়নের দক্ষিণ তিতপাড়া গ্রামের বাড়িতে।

পরিবারকে সমবেদনা জানাতে স্থানীয় মানুষরা ভীড় করছেন মৃত্যুর সংবাদ জানার পর থেকেই। বুধবার সকালে সমবেদনা জানাতে যান রংপুর ক্যান্টমেন্ট সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন।

শোকে মুহ্যমান হয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন মা গুলেনাহার বেগম আর বাবা লতিফর রহমানের মুখ থেকে বের হচ্ছে না যেন কোন কথা।

ছেলের মুত্যুর খবরে অসুস্থ্য হয়ে পড়া শয্যাশায়ী মা গুলেনাহার বেগম বলেন, কয়েকদিন আগে অনলাইনে ব্যাটার সাথে কথা হইল, কইল মা, মুই ভালো আছো। মিশন শ্যাষ হয়ছে। কিছুদিন পর দ্যাশোত আসিম। তোমরা ভালো থাকো।

কথা বলতে বলতেই ভাষা হারিয়ে ফেলা মা আবারো বললেন, ছেলেটাক ক্যানে মরি গেইল, আল্লাহ মোকে আগোত নিয়া গেইলে তো হইল হয়। মুই ছেলেটাক দেখির চাও।

বাবা লতিফর রহমান বলেন, আমার বাবাটা দুর্ঘটনাত মারা গেছে শুনছি, মোর ছাওয়াটাক মুই দেখির চাও। কদদিন মোর ব্যাটাটা আসিবে। তাড়াতাড়ি যেন নিয়া আইসে বাবাক।

সরকারের কাছে আবেদন সোনামুখটাক তাড়িতাড়ি যেন দেখির ব্যবস্থা করি দেয়।

বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম চতুর্থ। সবার বড় আবুজার রহমানও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সদস্য। দিনাজপুরের খোলাহাটি সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। প্রথমে দুর্ঘটনার খবরটি তাকেই জানানো হয় সেনাবাহিনী থেকে। ছুটি দেয়া হয় তাকে বাড়িতে ফেরার জন্য।

আবুজার রহমান বলেন, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ সে। বাকি দুই ভাই প্রাইভেট জব করলেও আমরা দু’জন সরকারি চাকরিতে। একেবারে ছোট বাদশা মিয়া রংপুরে পড়ছে পলিটেকনিকে।

তাকে হারানোর যে দুঃখ বেদনা কিভাবে সইবো আমরা। একজন চলে যাওয়া মানে বিরাট ক্ষতি হওয়া।

তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখভাল করছেন লাশ দেশের আনার ব্যাপারে।

চার বছর আগে জলঢাকা উপজেলার মীরগঞ্জ ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের মেয়ে শিমু আকতারের বিয়ে হয় জাহাঙ্গীর আলমের  সঙ্গে। মৃত্যুর বিষয়টি জানার পর থেকে কোনভাবে থামানো যাচ্ছে না তার কান্না। তার পাশে এসে কান্নায় ঢলে পড়েছেন মা শাহিনুর বেগমসহ আরো তিন বোন।

কান্নাজড়িত অবস্থায় শিমু জানান, পরশু ভিডিও কলে কথা হয় ওর সঙ্গে। জানালো ভালো আছি। কোন সমস্যা নেই। মিশন তো শেষের পথে। কিছুদিন পরই আসছি। ভালো থাকো।

তিনি বলেন, দ্রæত আমার স্বামীর মৃতদেহ যেন দেশে আনা হয় এই অনুরোধ করবো সরকার এবং সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে।

স্থানীয়রা বলছেন সভ্য, সহজ সরল প্রকৃতি মানুষ ছিলো জাহাঙ্গীর। ভালো খেলোয়ারও ছিলো সে। তারমত ছেলে এই এলাকায় নেই।

প্রতিবেশি শামসুল হক বলেন, কৃষক পরিবার তাদের। দুই ভাই সেনাবাহিনীতে চাকুরী করে। অত্যন্ত ভদ্র ছিলো সে। ভালো খেলোয়ারও ছিলো। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক। চাচাতো ভাই শাকিল হোসেন বলেন আমার সাথে তার পরিবারের ভালো মন্দ ছাড়াও  ভবিষৎ  নিয়ে আলোচনা করতো আমার ভাই সবসময় যেন অভিবাবক হিসাবে দেখি তাকে সৈই ভাই দুনিয়া থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় নিবে কল্পনাকরি নাই।আল্লাহ পাক ভাইকে জান্নত নসিব করুক।

আইএসপিআর সুত্রে জানা গেছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনাকালে তিন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী নিহত হন।

এরমধ্যে নীলফামারীর জাহাঙ্গীর আলমও রয়েছেন। তিন অক্টোবর সোমবার রাত ৮টা ৩৫মিনিটে বাংলাদেশ সময় চার অক্টোবর দুপুর ১টা ৩৫মিনিটে শান্তিরক্ষীদের একটি গাড়ি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস(আইইডি) বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটে।

২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেয় সে। মিশনের যাওয়ার আগে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করছিলো। ২০২১সালের ১২ডিসেম্বর মিশনে যায় জাহাঙ্গীর।

বুধবার ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন ও ডিমলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) লাইছুর রহমান পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে যান জাহাঙ্গীরের বাড়িতে।

ইউএনও বেলায়েত হোসেন জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন জাহাঙ্গীর। নিহত হওয়ার ঘটনায় শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

দাফতরিকভাবে এখোনো আমার কাছে কোন তথ্য আসেনি। তারপরও বিষয়টি খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/৫অক্টোবর/এআর)