ইভিএমে ভোট নিয়ে দ্বিধায় ইসি
প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩০
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনারদের বেশিরভাগ কথা জুড়েই থাকছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিষয়টি। তবে সবশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ‘ইভিএমে ভোটের চেয়েও দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আরও বড় সঙ্কট’ থাকার কথা বলছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনের ‘ভিন্ন ভিন্ন কথায়’ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘দ্বিধা’ প্রকাশ হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর ফলে জনমনেও এক ধরনের সংশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে। সেখানে বেশিরভাগ দলই ইভিএমে ভোটের দাবি জানিয়েছে। তবে ইভিএমে ভোটের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন।
ইতোমধ্যে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটসহ নির্বাচনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে কমিশন। প্রায় দুই লাখ ইভিএম কেনা এবং আগেরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে মঙ্গলবার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলছেন, ইভিএম নয় রাজনৈতিক দলের আস্থা ফেরাতে কাজ করবে কমিশন। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনাররা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ইভিএমের বিকল্প নেই।
সিইসি বলেছেন, ব্যালট বা ইভিএমের চেয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই বর্তমান কমিশনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যেটা চাচ্ছি, ইভিএম বা ব্যালট মূল কথা নয়। মূল কথা হলো সবাইকে চেষ্টা করতে হবে একটা সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ, নির্বিঘ্ন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ঐ নির্বাচনে ইভিএম থাকল, না কি ব্যালট থাকল সেটা বড় কথা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহনই মূখ্য।’
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক বক্তব্য দেওয়াকে কমিশনারদের ‘মন দি¦ধান্বিত’ দেখছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘কমিশন কখনো রাজনৈতিক দলের আস্থা আবার কখনো ইভিএমে জোর দেওয়ার যে বক্তব্য দিচ্ছেন, আমার মনে হয় বিষয়টি কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন তারা সেটা বুঝতে পারছেন না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে তারা কি পেলেন সেটাও বোঝা যায়নি।’
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য থেকে উত্তরণের জন্য কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারো বসার পরামর্শ দিয়ে সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে পারে। আর ভিন্ন রকম বক্তব্যের একটা কারণ হতে পারে অর্থনৈতিক সংকটে সরকার ইভিএমের জন্য টাকা ছাড় করতে পারবে না, যে কারণে নিজেদের মুখ রক্ষা করতে এখন ইভিএম থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে রাজনৈতিক আস্থার প্রতি।’
কমিশনের নানা বক্তব্যকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এই কমিশনের একটাই কৌশল সেটা এই সরকারকে জয়ী করা। তাই তাদের নিজেদের বক্তব্য নিয়ে খুব একটা ভাবনা নেই।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘সংলাপের পর দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে ইভিএমে ভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কোনোভাবেই সিইসি বলতে পারেন না তারা ইভিএম নয় রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন করতে চায়। যদি তাই চাইতো, তবে ইভিএমের সিদ্ধান্ত নিত না।’
এদিকে নির্বাচন কমিশন ১৫০ আসনে ইভিএম ভোটের সিদ্ধান্ত নিলেও বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। এর মূল কারণ অর্থ বরাদ্দ। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ইসি যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটি তারা আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিতেই পারে। তবে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি সরকারের এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের। ইসির প্রস্তাবিত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব না হলে অর্থ মন্ত্রণালয় সেটা তাদের বোঝাবে।’
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘যদিও বল এখন আমার কোর্টে, কিন্তু টাকার থলি অর্থ মন্ত্রণালয়ে। মূল ইস্যু হলো আস্থার বিষয়টি। সেটিকে পাশ কাটিয়ে শুধু বাজেট নিয়ে আলোচনা করলে হবে না। তবে আমি মনে করি, ইসি যেটা চাইবে সরকার সেটা দিতে বাধ্য। পাশাপাশি সরকার যদি মনে করে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়, সেটিও আলোচনা করে ইসিকে জানানো দরকার।’
এছাড়া সিইসি গত মঙ্গলবার যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে নির্বাচনী চূড়ান্ত রোডম্যাপ প্রকাশের আগে গত ২৪ আগস্ট ইভিএম নিয়ে দেওয়া তার বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। সেসময় তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন দল কী বলেছে, তা কমিশনের কাছে মুখ্য ছিল না। কীভাবে ভোট করলে সুষ্ঠু হবে, সেটাই মুখ্য বিবেচনায় ছিল। আগামী সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমএ ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।’
নির্বাচনী চূড়ান্ত রোডম্যাপ প্রকাশের পর ইসি মো. আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সিইসির বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি। সেসময় বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি ইভিএমে ভোট ইসির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমরা যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কাজ করি সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছি। ইভিএমের পক্ষে ও বিপক্ষে পেয়েছি মতামত পেয়েছি, নিরপক্ষে মতামতও পেয়েছি। সেটাকে আমরা এনালাইসস করেছি বোঝার স্বার্থে। যদি ৩০০ আসনের টাকা দিতে পারে এবং যারা নির্বাচন করবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন তাহলে সব আসনেই ইভিএমে ভোট করবো আমরা।’
একই সুরে কথা বলেছিলেন ইসি বেগম রাশেদা খানম এমিলিও। সেসময় তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেছিলেন, ‘ইসির কি এই স্বাধীনতা থাকবে না? আমরা তাদের (রাজনৈতিক দল) সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের ইচ্ছাটা জেনেছি। আমরা যদি বুঝি এই মেশিন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবো, ইলেকশনটা তো আমাদেরকেই নামাতে হবে। অন্য কেউ তো ইলেকশনটা করে দেবে না। আমরা যদি বুঝি এটা দিয়ে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব তাহেলে কে চাইলো কে চাইলো না এটা কি মেটার করে?’
নির্বাচনে ইভিএম নয় রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ফেরাতে কমিশন কাজ করবে সিইসির মঙ্গলবারের বক্তব্যের বিষয়ে কমিশনের দুই ধরণের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে কি না দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বেগম রাশেদা খানম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এর আগে ২০১৮ সালে ব্যালটে যখন ২৯৪ আসনে ভোট হয়েছে, তখন আপনারা বলেছেন রাতের ব্যালট চুরি হয়েছে। আমরা পরীক্ষানীরিক্ষা করে দেখেছি ইভিএমেই ভোট করা নিরাপদ।’
(ঢাকাটাইমস/০৬অক্টোবর/ডিএম)