জেলেদের চাল যাচ্ছে কোথায়

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৫৯

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

ইলিশের প্রজনন নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে আজ রাত ১২টা থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ মাছ ধরা, কেনা-বেচা ও মজুদ নিষিদ্ধ। এ সময়ে মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৭ জেলে পরিবারের জন্য ২৫ কেজি করে মোট ১৩ হাজার ৮৭২ মেটিক টন ভিজিএফের চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এই চাল যাতে নয়ছয় না হয় এবং প্রকৃত জেলে যাতে চাল পায়, তা নিশ্চিত করতে  ইতেমধ্যেই সংশ্লিষ্ট ৩৭ জেলা প্রশাসকের কাছে ৬টি নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছরই নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য একাধিকবার ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে থাকে সরকার। এ সময় জেলেদের জন্য দেওয়া সরকারি চাল নয়ছয় হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন জেলেরা।

জেলেদের অভিযোগ, ইলিশ ধরার নিষিদ্ধসময় শেষেও এ চাল হাতে পাননা বেশিরভাগ জেলে। কোনো কোনো এলাকায় নিবন্ধিত এই জেলেদের নামে বরাদ্দকৃত ভিজিএফের এই সরকারি চাল জেলেদের ভাগ্যেই জোটে না। তা চলে যায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারসহ বণ্টনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের পেটে। তারাই নয়ছয় করে এসব চাল আত্মসাৎ করেন।

এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহা. আতিয়ার রহমান বুধবার রাতে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এ চাল যাতে নির্দিষ্ট নিবন্ধিত জেলেরা পান তা নিশ্চিত করতে যথাথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারের অন্য কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন। যদি কোনো অনিয়ম ধরা পড়ে বা অনিয়মের খবর পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলের জন্য বরাদ্দকৃত চাল যাতে জেলেরাই পান- তা নিশ্চিত করতে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।’

মৎস্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘১৫৫টি উপজেলায়ই মোবাইলকোর্ট প্রস্তুত থাকবে। প্রয়োজন অনুযায়ী তারা কর্যক্রম পরিচালনা করবে।’

এদিকে মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালে নদীতে ইলিশ শিকার ঠেকাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নৌ পুলিশ। টহল জোরদার করাসহ নদীতে থাকছে নৌপুলিশের বিশেষ দলের কড়া পাহাড়া। কোনো জেলেকে মাছ ধরতে দেখলেই জাল জব্দসহ গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছেন নৌপুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. শফিকুল ইসলাম।

তিনি বুধবার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ শিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এ সময়টা কেটে গেলে বড়বড় ইলিশ মিলবে জেলের জালে। আর এ কারণেই ওই ২২দিন আমরা কঠোর অবস্থানে থাকব, যেন কোনো জেলে ইলিশ শিকার করতে না পারে।’
 
অন্যদিকে দরিদ্র এসব জেলে নৌকা ও জাল কেনার টাকা মহাজনদের কাছ থেকে দাদন (ঋণ) নিয়ে থাকেন। ইলিশ ধরা বন্ধ থাকার সময় সরকারি চাল না পেয়ে তাদের ঋণের বোঝা আরও বাড়ে। সবমিলিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে আরও হতাশ হয়ে পড়েন জেলেরা। একইসঙ্গে তাদের সংসার চালানোর অনিশ্চয়তাও বাড়ে।

তবে মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, জেলেরা কষ্টে আছে, ঋণের জালে আটকে আছে, সে কথা সত্যি। ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকাকালে কটাদিন ধৈর্য্য ধরে কাটাতে হবে তাদের। এরপরই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সুদিন। নিষেধাজ্ঞার সময় শেষে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে জেলের জালে। তাদের মুখে হাসি ফুটবে বলেও মনে করছেন মৎস্য কর্মকর্তারা।  

মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত প্রকৃত জেলেদের চাল পাওয়া নিশ্চত করতে গত মঙ্গলবার ৩৭ জেলা প্রশাসককে বিশেষ কিছু নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. এসএম যোবায়দুল কবির স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ৬টি বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকরা মঞ্জুরিকৃত ভিজিএফের চাল ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে ইলিশ আহরণে বিরত থাকা নিবন্ধিত ও প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মধ্যে ১ নভেম্বরের মধ্যে বিতরণ সম্পন্ন করবেন এবং নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হিসাব সংরক্ষণ করবেন এবং ৬ নভেম্বরের মধ্যে মাস্টাররোল (সুবিধাভোগীদের তালিকা) পাঠাবেন।
জেলা প্রশাসকরা বরাদ্দ প্রাপ্তির ৫ কর্মদিবসের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের অনুকূলে উপ-বরাদ্দ প্রদান করবেন এবং সংশ্লিষ্ট জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে অবহিত রাখবেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপ-বরাদ্দ প্রাপ্তির ৫ কর্মদিবসের মধ্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের অনুকূলে ডিও (ছাড়পত্র) প্রদান করবেন এবং বিতরণসূচি তৈরি করা সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন।

জেলা প্রশাসকরা ভিজিএফ চাল বরাদ্দের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যকে অবহিত রাখবেন। জেলা প্রশাসক কৃর্তক ভিজিএফ চাল বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা কার্যক্রম শেষে মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর বরাবরে প্রতিবেদন দাখিল করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন। চাল বিতরণকালে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বা তার প্রতিনিধি এবং ট্যাগ (সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত) অফিসারের উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন।

জেলেরা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি চালের সুবিধাভোগী হতে পারেন সে জন্য এসব চাল পরিবহনের জন্য ৩৪ লাখ ৬৮ হাজার ৪৫ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ২৭ জেলা প্রশাসকের অনুকূলে। জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো এক চিঠির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
 
চাল পাবেন কোন কোন জেলার জেলেরা

ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপর, রাজবাড়ী, নরসিংদী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী, লহ্মীপুর, চাঁদপর, কক্সবাজার, খুলনা, বাগেরহাট, কৃষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, গাইবান্ধা, কড়িগ্রাম, বরিশাল, পিরোজপর, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা ও ঝালকাঠী জেলার অধীন ১৫৫টি উপজেলার নিবন্ধিত ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৭ জন জেলে মোট ১৩৮৭২.১৮ মেটিকটন চাল পাবেন।

সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০১৯) অনুযায়ী, দেশের ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য সম্পদ আহরণের সাথে যুক্ত। মোট জিডিপির ২৫.৭১ শতাংশ, অর্থাৎ এক চতুর্থাংশ অর্জিত হয় এই মৎস্য সম্পদ থেকে। গত ৩০ বছরে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ২৫ গুন। দেশের ১২৫টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যায় বলেও ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে।

অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১১টি ইলিশ উৎপানকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মোট ২৪ হজার কিলোমিটার নদ-নদী রয়েছে, যেখানে মাছ পাওয়া যায়। এর আয়তন প্রায় ১০.৩২ লাখ হেক্টর।

জেলেদের দুঃখগাথা

ঢাকা টাইমসের পিরোজপুর প্রতিনিধি মো.ফয়সাল হাসান জানিয়েছেন, পিরোজপুরের নেছারাবাদে সন্ধ্যা নদীতে ভরা মৌসুমেও কাঙ্খিত ইলিশ না মেলায় দুর্দশায় পড়েছেন এখানকার জেলেরা। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। হতাশ হয়ে পড়েছেন উপজেলার ২৮৫৬ জন জেলে। জালে ইলিশ না মেলায় কোনো কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী জেলের ঘরে নেই পূজার আনন্দটুকুও। তারা মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে জাল ও নৌকা কিনে নদীতে ইলিশ শিকার করে থাকেন। তবে এ বছর এখন পর্যন্ত কাঙ্খিত ইলিশ না মেলায় মহাজনের দাদন পরিশোধ তো দূরের কথা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। গত এক সপ্তাহ পর্যন্ত নদীতে টানা দুই থেকে তিনবার জাল ফেলে ছাট দুই তিনটি ইলিশ ছাড়া আর কিছুই মেলনি। সে মাছও মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ করতে আড়তে দিয়ে আসতে হয়েছে। সংসারের খরচ চালাতে স্থানীয় এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছেন তার।

উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওবাইদুল হক বলেন, ‘ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে উপজেলায় মোট ২৮৫৬ জন জেলেকেই সরকারিভাবে চাল দেয়া হবে।’
 
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীতে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৭ হাজার হলেও প্রায় ১ লাখ জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জেলেরা অভিযোগ করছেন, সরকারিভাবে যে সহযোগিতা করা হয় তা প্রকৃত জেলেরা পাচ্ছেন না।

ডাকুয়া ইউনিয়নের জেলে শামীম বলেন, ‘এ বছর বন্যার প্রভাব গেছে। আমরা জাল বাইতে পারি নাই এতদিন। ২২ দিনের অবরোধ দেবে সরকার। এ সময় সরকার যে ২৫ কেজি চাল দেবে তাও আবার খেয়ে ফেলে মেম্বার চেয়ারম্যান।’

বদনাতলী এলাকার জেলে হাফিজুর রহমান বলেন, সরকার যে অনুদান দেয় তা যদি পূর্ণভাবে জেলেদের মধ্যে বিতরণ করে তাহলে ভালো হয়। আর চালের সাথে অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও দরকার। শুধু চাল দিয়ে তো চলে না।’

পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আমাদের সব উপজেলায় মৎস্য আড়ত, বাজারসহ সব জায়গায় মাইকিং করে লিফলেট বিতরণ করছি। শুক্রবার থেকে আমাদের অভিযান পরিচালিত হবে। জেলা-উপজেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ সকলের সহযোগিতায় আমরা নদী ও সমুদ্রে অভিযান পরিচালনা করব।

(ঢাকাটাইমস/০৬অক্টোবর/এফএ)