অ্যানালগ পদ্ধতির লোড ব্যবস্থাপনা জাতীয় গ্রিডের বড় ঝুঁকি

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২২, ১০:০৩ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২, ১১:১৫

ওমর ফারুক, ঢাকাটাইমস

গত মঙ্গলবার জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঞ্চালন লাইনে বিপর্যয়ের ফলে প্রায় ৭ ঘণ্টা ব্ল্যাকআউট থাকে রাজধানীসহ দেশের অর্ধেক এলাকা। চরম ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানালগ পদ্ধতির লোড ব্যবস্থাপনাই জাতীয় গ্রিডের অন্যতম ঝুঁকি। এই লোড ব্যবসস্থাপনাকে ডিজিটাল করলে পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

অন্যদিকে সঞ্চালন লাইন আধুনিকায়নে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এর কর্মকর্তারা।

এর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে জাতীয় গ্রিডে। সেসময় টানা ১৪ ঘণ্টা অন্ধকারে ছিল গোটা দেশ। এ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি জাতীয় গ্রিডে মহাবিপর্যয়ের পর কারিগরি ত্রুটি, দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধতা এবং নির্দেশ পালনে অবহেলাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল করা, কারিগরি ব্যবস্থার উন্নয়নসহ ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল।
 
কিন্তু ৮ বছরেও সেই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি গুরুত্বের সঙ্গে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল করার বিষয়ে যে সুপারিশ করা হয়েছিল তাও পাশ কাটিয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
 
বাংলাদেশের গ্রিড সিস্টেম এখনো পরিচালিত হচ্ছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। উন্নত বিশ্বে সঞ্চালন লাইন স্বয়ংক্রিয় পর্যায়ে উন্নত হলেও বাংলাদেশে এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানালগ পদ্ধতিতে লোড ব্যবস্থাপনা ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে জাতীয় গ্রিডকে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দিলেও ততোটা গুরুত্ব পায়নি সঞ্চালন লাইন আধুনিকায়ন। ঘাটতি রয়ে গেছে কারিগরি উন্নয়নে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ন্যাশনাল গ্রিড এখন যে সিস্টেমে আছে, সেটাকে আধুনিকায়ন করা জরুরি। ভালো ট্রান্সমিশন সিস্টেম থাকলেও বিতরণ সাইট অ্যানালগ পদ্ধতিতে চলছে। যেটা কাটিয়ে উঠতে স্মার্ট গ্রিড ম্যানেজমেন্টের দিকে এগুতে হবে। ফলে টোটাল ব্যবস্থাটা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং ভবিষ্যতে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।’
 
সঞ্চালন লাইন আধুনিকায়নে সরকার কাজ করছে জানিয়ে পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী মোরশেদ আলম খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্মার্ট গ্রিড ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়াটি কিছুটা জটিল। ট্রান্সমিশন বসানোসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই বছরের বেশি সময় লাগতে পারে। এটা সত্য, ২০১৪ এর সুপারিশের পর সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি আধুনিকায়ন হয়নি। তবে আমাদের এখন যেসব টেকনোলজি আছে তার বেশিরভাগই আধুনিক। এটাকে আরো আধুনিক করতে সরকার কাজ করবে।’

এছাড়া ভবিষ্যতে গ্রিড বিপর্যয়ে আগাম প্রতিকার গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

স্মার্ট গ্রিড ম্যানেজমেন্ট কি?

স্মার্ট গ্রিড ম্যানেজমেন্ট এমন একটি সিস্টেম, যেখানে সরবরাহকারী এবং গ্রহণকারীর মধ্যে একটি যোগাযোগ স্থাপিত হয় ও তথ্য আদান-প্রদানের পাশাপাশি দক্ষভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এ সিস্টেমে দেশের সকল পাওয়ার প্লান্টের উৎপাদিত বিদ্যুৎ একটি স্থানে জমা হয় এবং প্রতিটি এলাকার প্রয়োজন মোতাবেক বিদ্যুৎ বণ্টন করা হয়।

স্মার্ট গ্রিড সিস্টেমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে খুব সহজে রিয়েল টাইম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের বিদ্যুৎ চাহিদা, অটোমেটিক ফল্ট ক্লিয়ারিং স্বয়ংক্রিয় উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কোনো কারণে কোনো লাইনে, ফেজে বা গ্রাউন্ডে ফল্ট হলে এ সিস্টেম গ্রিডকে রক্ষার জন্য মূল লাইন থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং ফল্টের স্থান ও যথাযথ কারণ কন্ট্রোল সেন্টারে প্রদর্শন করা হয়।

স্মার্ট গ্রিড টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ খাতে এনার্জি লস কমে আসবে। মেইন্টেনেন্স খরচ কমে আসবে। পাওয়ার ফ্যাক্টর কারেকশন চার্জ কমবে। কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কম হবে। অপারেশনাল খরচ কমবে। পাওয়ার কাট এর মতো দুর্ঘটনা কমে আসবে, সিস্টেম লসও কমে যাবে।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার টানা ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লি. (এপিএসসিএল) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা যায়, ইস্টার্ন গ্রিডে এপিএসসিএল’র আওতাধীন চালু থাকা ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট (নর্থ ও সাউথ), ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট, ২০০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং ৫৩ মেগাওয়াটের গ্যাস ইঞ্জিন একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশের একটি অংশ পুরোপুরি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।

বিদ্যুতের এই বিপর্যয়ের কারণে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট বিভাগসহ দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিল্প কারখানা, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শপিং মল বন্ধ হয়ে যায়।

বিদ্যুৎ সংকটে হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যাহত হয়। ঢাকা মেডিকেলে বিকল্প ব্যবস্থায় আইসিইউ এবং ওটি সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। একযোগে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বাসাবাড়ি, অফিস আদালতসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিপাকে পড়েন।

(ঢাকাটাইমস/০৬অক্টোবর/এফএ)