ডায়াবেটিস প্রতিরোধে অব্যর্থ ঘরোয়া টোটকা, জেনে নিন

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২২, ১১:৩২ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২, ১২:১৬

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

অস্বাস্থ্যকর খাবার, জীবনযাত্রার অনিয়ম ও শরীরচর্চার অভাবে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। ডায়াবেটিস জিনগত হলেও টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। অজান্তেই ডায়াবেটিস কোপ ফেলে আমাদের কিডনি, হার্ট, চোখ, লিভারের মত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে। যে কারণে পরবর্তীতে কোনও শারীরিক জটিলতা হলে এবং অবস্থা কঠিন হলে মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওয়ের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও ডায়াবেটিস থাকলে কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। যে কারণে এই সমস্যায় সবদিক থেকে নিজেকে সাবধানে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যখন কারও ডায়াবেটিস হয়, তখন ওই মানুষের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে দেহের কোষে গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারে না। এতে করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণত প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এতে করে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো প্রকাশিত হতে থাকে।

নিউ ইয়র্কের ওয়েল কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের একটি গবেষণা বলছে, সঠিক খাবার খাওয়ার পাশাপাশি কোন ক্রমে সেই খাবার খাওয়া হচ্ছে তার উপরেও রক্তের শর্করার পরিমাণ অনেকটা নির্ভর করে। গবেষকদের দাবি, কার্বোহাইড্রেট প্রথমে খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ যতটা বৃদ্ধি পায় তার তুলনায় আগে শাক-সব্জি ও প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে অনেকটাই কম থাকে রক্তে শর্করার মাত্রা। আগে প্রোটিন ও শাক-সব্জি খেলে আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও দু'ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার মাত্রা কম থাকে যথাক্রমে ২৯, ৩৭ ও ১৭ শতাংশ।

প্রতিদিনের অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্টফুড, চিনি, কার্বোহাইড্রেট খাওয়া- এইসবই কিন্তু বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা। যে কারণে ডায়াবেটিসের সমস্যায় আগেই যেমন রাশ টানতে হবে জীবনযাত্রায় তেমনই খাদ্যাভ্যাসেও আনতে হবে পরিবর্তন।

ডায়াবেটিস সাধারণত দুই ধরনের হয়-- টাইপ-১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস। মোট রোগীর ৯৫% টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য না-হলেও সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে আটকানো সম্ভব। যে সমস্ত ব্যক্তির ওজন বেশি, হাই-কোলেস্টেরল বা পরিবারে ডায়াবেটিস রোগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের অবশ্যই আগে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পদক্ষেপ করা উচিত।

দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনলেই ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসের ফলে হওয়া গুরুতর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতা থেকে অনেকাংশে এড়ানো যেতে পারে। জেনে নিন যেভাবে ডায়াবেটিস রোগকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে-

 

অতিরিক্ত ওজন কমানো

শরীরের ওজন বৃদ্ধির কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। এই কারণে ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধ করতে অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে। একটি গবেষণায় চিকিৎসকরা দেখতে পেয়েছেন যে, ডায়েটের পরিবর্তন এবং নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে ৭% শারীরিক ওজন কমিয়ে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৬০% কমে গিয়েছে।

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশ অনুযায়ী, যে সমস্ত ব্যক্তির ডায়াবেটিস রোগের প্রাথমিক উপসর্গ রয়েছে বা প্রি-ডায়াবেটিস উপসর্গ রয়েছে, তাঁরা ৭% থেকে ১০% ওজন কমিয়ে এই রোগের সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এর থেকেও বেশি ওজন কম হলে তা শরীরের পক্ষে খুবই উপকারী।

চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রথমে ছোট ছোট লক্ষ্যমাত্রা বানাতে হবে। যেমন-- সপ্তাহে ৫০০ গ্রাম বা ১ কেজি ওজন কমাতে হবে, সেটা স্থির করে তবেই ওজন কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।

 

শারীরিক ব্যায়াম

নিয়মিত ব্যায়াম করলে ওজন কমানো যায়, ব্লাড সুগারের স্তর কম হয় এবং ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।

 

শরীরকে সক্রিয় রাখতে যেসব ব্যায়াম

অ্যারোবিক ব্যায়াম: দ্রুত হাঁটা, সাঁতার কাটা, বাইক চালানো বা দৌড়ানোকে অ্যারোবিক ব্যায়াম বলা হয়। প্রতিদিন ৩০ মিনিট ধরে মাঝারি থেকে কঠিন অ্যারোবিক ব্যায়ামের লক্ষ্য স্থির করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট শরীরচর্চা করলে তা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ অনেক সাহায্য করে।

সীমিত নিষ্ক্রিয়তা: শরীরকে সক্রিয় রাখতে দীর্ঘক্ষণ নিষ্ক্রিয়তা থেকে বিরত থাকা উচিত। অনেকটা সময় একই যায়গায় বসে না-থেকে বিশ্রামকে ছোট ছোট বিরতিতে ভেঙে নিলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

 

পুষ্টিকর সবুজ শাক-সবজি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া

শাক-সবজি আমাদের ডায়েটে ভিটামিন, খনিজ এবং কার্বোহাইড্রেট যুক্ত করে। কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে শর্করা, স্টার্চ এবং ফাইবার থাকে। শর্করা থেকেই আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপন্ন করে। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে দেয়। নীচে ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবারের একটি তালিকা দেওয়া হল-

টমেটো, গাছের ফল এবং মরিচ

শাক, ব্রোকলি এবং ফুলকপি জাতীয় স্টার্চ বিহীন সবজি

মটরশুঁটি, ছোলা এবং মুসুর ডাল জাতীয় বীজ-ভিত্তিক খাবার

যে সমস্ত খাবারে খারাপ কার্বোহাইড্রেট রয়েছে, সেগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। এই জাতীয় খাবারে কম পুষ্টি বা ফাইবারের পরিমাণ কম থাকে এবং চিনির পরিমাণ বেশি থাকে, যা শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক।

কার্বোহাইড্রেট-জাতীয় খাবার, যেমন-ভাত, আলু কম খান। বেশি গরু বা ছাগলের গোশত খাবেন না। আইসক্রিম, পনির, ফাস্টফুড, কোল্ড ড্রিঙ্কস ও কৃত্রিম জুস এড়িয়ে চলুন। ঘি বা মাখন কম খান বা বাদ দিন। দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। ২৪ ঘন্টায় অন্তত ৬ ঘন্টা ঘুমান। টেনশন কমাতে হবে।

 

স্বাস্থ্যকর ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া

ফ্যাটযুক্ত খাবারে প্রচুর ক্যালোরি থাকে, যার কারণে এগুলো পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং ওজন কমাতে নিজের ডায়েটে অসম্পৃক্ত ফ্যাট জাতীয় খাবার যুক্ত করা উচিত। অসম্পৃক্ত ফ্যাটকে গুড ফ্যাটও বলা হয়।

অসম্পৃক্ত ফ্যাট জাতীয় খাবারগুলো হল--

জলপাই, সূর্যমুখী, কুসুম, তুলো বীজ এবং ক্যানোলা তেল

চিনেবাদাম, ফ্ল্যাক্সসিড এবং কুমড়োর বীজ

স্যামন, ম্যাকরেল, সার্ডিন, টুনা এবং কড জাতীয় মাছ

মাংস এবং দুগ্ধজাত খাদ্যকে সম্পৃক্ত ফ্যাট বা ব্যাড ফ্যাট হিসেবে ধরা হয়। ডায়েটে এই জাতীয় খাবারগুলির পরিমাণ খুবই কম থাকা উচিত।

 

সঠিক ডায়েট বেছে নেওয়া

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার জন্য সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল-- সঠিক ডায়েট বেছে নেওয়া। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স, প্যালিও বা কিটো জাতীয় ডায়েটগুলো ওজন কমাতে সাহায্য করবে ঠিকই, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী উপকারিতা বা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে খুবই কম গবেষণা রয়েছে। এই কারণে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সঠিক ডায়েট বেছে নেওয়া খুবই জরুরি।

 

ডায়েটে সঠিক খাবার বেছে নেওয়ার সব চেয়ে ভালো উপায় হল, প্লেটে থাকা খাবারকে পরিমাপ করে এবং প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে তিনটি ভাগ করে নেওয়া।

প্রথম ভাগ: ফলমূলএবং স্টার্চ বিহীন শাক-সবজি

দ্বিতীয় ভাগ: শস্য জাতীয় খাবার

তৃতীয় ভাগ: মাছ বা চর্বিহীন মাংস জাতীয় পুষ্টিকর খাবার

 

ডায়াবেটিস ডায়েট চার্ট

সকাল ৬ টা: একচামচ মেথিগুঁড়া এবং পানি ।

সকাল ৭টা: চিনি ছাড়া এক কাপ চা এবং ১-২টা বিস্কুট।

সকাল ৮.৩০ টায়: ১ প্লেট ওটমিলস + অর্ধ বাটি শস্যযুক্ত খাদ্য + ১০০ মিলিমিটার ক্রিম-মুক্ত দুধ চিনি ছাড়া।

সকাল ১০.৩০ মিনিটে: ১টা ছোট ফল বা ১কাপ পাতলা এবং চিনি ছাড়া বাটারমিল্ক বা লেবুর পানি।

মধ্যাহ্নভোজে ১-২টা মিশ্রিত আটার রুটি, ১ বাটি ভাত, ১ বাটি ডাল, ১ বাটি দই, অর্ধ কাপ সয়াবিন বা পনির সবজি, অর্ধ বাটি সবুজ সবজি, এক প্লেট সালাদ।

৪ টা: চিনি ছাড়া ১ কাপ চা + ১-২ চিনি কম বিস্কুট বা টোস্ট।

৬ টা: ১ কাপ স্যুপ

৮.৩০ টা: ২টি আটার রুটি, ১ টি বাটি চাল, ১ বাটি ডাল, আধা বাটি সবুজ সবজি, এক প্লেট সালাদ।

১০.৩০ টা: চিনি ছাড়া১ কাপ ক্রিম ফ্রি দুধ।

 

এছাড়া আপনার যখন খিদে পাবে তখন কাঁচা শাকসবজি, সালাদ, কালো চা, সূপ, পাতলা বাটার, লেবুর পানি, অ্যালোভেরা, বাদাম, মাছ, করলা, হলুদ ইত্যাদি খেতে পারেন। এছাড়া চিনি, মধু, মিষ্টি, শুকনো ফল এগুলো এড়িয়ে চলুন।

 

যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন

লবণ: লবণ ডায়াবেটিসের জন্য প্রধান দায়ী। আপনি যে কোন ফল বা সবজি থেকে আপনি যথেষ্ট লবণ গ্রহণ করে থাকেন তাই যতটা সম্ভব লবণ কম খাওয়ার চেষ্টা করুন।

চিনি: সুক্রোজ, একটি টেবিল চিনি, ক্যালোরি এবং কার্বোহাইড্রেট ছাড়া কিছুই প্রদান করে না। এছাড়াও, আপনার সুক্রোজ হজম করার জন্য ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। মধু, গুড় ইত্যাদি গ্রহণ করুন যাতে প্রাকৃতিক ভাবেচিনি রয়েছে।

চর্বি: অত্যধিক চর্বি গ্রহণ করা অবশ্যই একটি ভাল অভ্যাস নয়। তেলে ভাজা জাতীয় খাবার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা উচিৎ। তবে এটা মনে রাখবেন যে আপনাকে অল্প পরিমাণ তেল গ্রহণ করতে হবে যাতে চর্বিযুক্ত ভিটামিনগুলো, বিশেষ করে ভিটামিন ই হজমে সুবিধা হয়।

আমিষভোজীদের জন্য: লাল মাংস গ্রহণ করা বন্ধ করুন। নিরামিষী খবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। একটি নিরামিষ খাদ্য জন্য যেতে চেষ্টা করুন।যদি আপনি তা না করতে পারেন তাহলে আপনি পলটির ডিম খেতে পারেন। এছাড়াও আপনি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার মাছ খেতে পারেন।

দুগ্ধজাত দ্রব্য: কম ফ্যাট জাতীয় দুধ যেমন দই খেতে পারেন। হাই ফ্যাট চিসসের বদলে লো ফ্যাট চিস খেতে পারেন।

চা এবং কফি: প্রতিদিন দু কাপের বেশি চা বা কফি খাবেন না। আয়ুর্বেদিক চা খাওয়ার চেষ্টা করুন।

ময়দা এবং ময়দার তৈরি দ্রব্য: ময়দার বদলে আটার জিনিস খাওয়া শুরু করুন, এছাড়া সয়াবিন এবং ভাত খেতে পারেন।

উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচকযুক্ত খাবার: ভাত, আলু, গাজর, পাউরুটি এবং কলা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন কারণ এগুলো রক্তে চিনির মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস রোগ ঠেকাতে যেসব খারাপ অভ্যাস সবার আগে বাদ দিতে হবে, তার মধ্যে রয়েছে ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস। কারণ এগুলো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দেয়।

(ঢাকাটাইমস/০৬ অক্টোবর/আরজেড)