কী হচ্ছে মৎস্যজীবী লীগে?

প্রকাশ | ০৭ অক্টোবর ২০২২, ০৯:২১

জাফর আহমেদ, ঢাকাটাইমস

আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সহযোগী সংগঠন হিসেবে মৎস্যজীবী লীগকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। স্বীকৃতি পাওয়ার পরে দৃশ্যমান কোনো ভালো কাজ না থাকলেও একের পর এক বির্তক আর সমালোচনার জন্ম দিয়ে চলেছে সংগঠনটি।

বিশেষ করে তাজরীন গার্মেন্টসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মূল আসামিকে ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবি লীগের সভাপতি করার পরেই বির্তক সামনে আসে। তবে সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক গঠনতন্ত্র না মেনে পাঁচ নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে মৎস্যজীবী লীগ।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং মৎস্যজীবী লীগের নেতাকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন কি হচ্ছে সংগঠনের মধ্যে? তাদের জিজ্ঞাসা কেন বারবার সংগঠনকে বির্তকিত করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। সংগঠনকে এগিয়ে নেওয়ার চেয়ে বির্তকিত এবং বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পদ দিয়ে প্যাকেট বাণিজ্যই দায়িত্বপ্রাপ্তদের মনোযোগ বেশি বলে অভিযোগ তাদের।

মৎস্যজীবী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নিজের অপরাধ ঢাকতে এবং একক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মরীয়া সাধারণ সম্পাদক লায়ন শেখ আজগর নস্কর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদকক একক সিদ্ধান্তে বা ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে কাউকে অব্যহতি বা বহিষ্কার করার ক্ষমতা রাখেন না। অথচ তিনি সম্প্রতি গঠনতনন্ত্র না মেনে পাঁচ নেতাকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

জানা গেছে, গত ৯ সেপ্টেম্বর দেশের বাইরে যান মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন শেখ আজগর নস্কর। কাউকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে না যাওয়ায় সংগঠনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এর ফলে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে না পারায় সংগঠনের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বিষয়টি জানান।

পরে ওবায়দুল কাদের লায়ন শেখ আজগর নস্করকে ফোন করে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং মৎস্যজীবী লীগ নেতাকর্মীদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নিদের্শনা দেন।

ওবায়দুল ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশ পেয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর সেকারণেই ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে লায়ন শেখ আজগর নস্কর তাদের অব্যাহতি দেন বলে অভিযোগ করেছেন অব্যাহতি পাওয়া নেতারা।

মৎস্যজীবী লীগ নেতাকর্মীদের দাবি, সংগঠনকে ভাগাভাগি করে দোকানে পরিণত করেছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এর বড় প্রমাণ হিসেবে তারা দেখাচ্ছেন, আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মূল আসামি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতির পদ দেওয়া।

অভিযোগ উঠেছে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দেলোয়ার হোসেনকে এই পদ দিয়েছেন সভাপতি সাইদুর রহমান। দেলোয়ারের টাকায় তিনি মগবাজার ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া দেলোয়ারের ভাড়া করা গাড়িতে এখন তিনি চলাচল করেন (গাড়ি নং ঢাকা মেট্রো-চ ১১৯৯৯১)।

অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক শেখ আজগর নস্করের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেতাকর্মীরা বলছেন, মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি সাইদুরের যোগসাজশে বির্তকিত লোকদের কমিটিতে জায়গায় করে দিচ্ছেন তিনি। ঢাকা বাইরে বিভিন্ন জেলার যেমন সিলেট, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, গাজীপুরে টাকার বিনিময়ে ছাত্রদল এবং জামায়াতের নেতাকে দলে ঢুকিয়েছেন।

এমনকি শেখ আজগর নস্কর তার নিজের অফিসের জিএমকে মৎস্যজীবি লীগের অর্থ সম্পাদক করেছেন, যিনি একসময় ছাত্রদল নেতা ছিলেন। এছাড়া শেখ আজগর নস্করের সংগঠনের নাম ব্যবহার করে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। তার বনানীর অফিসে নেতাকর্মীরা নিয়মিত হাজিরা দেন এবং পদ বাণিজ্যের লেনদেন এ অফিসে বসেই হয়।

এছাড়া গ্ল্যাসকো করপোরেশন নামে বিদেশে কর্মী পাঠানোর একটা এজেন্সিও আছে শেখ আজগর নস্করের। এই অফিসে বসেই তিনি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করেন তারা। এছাড়া তিনি হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

নেতাকর্মীরা বলছেন, সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককের পদ বাণিজ্য ও তাদের অর্পকমের প্রতিবাদ করলেই অব্যাহতি দিয়ে হয়রানি করা হয়। এসব অভিযোগ নিয়ে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বরাবর চিঠি দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৎস্যজীবী লীগের সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ১৩-১৪ জেলার কার্য সম্পন্ন করেছেন। বাকিগুলোর অধিকাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি হলেও তার তাদের কোনো নজর নেই। কারণ যারা টাকা দিয়ে কমিটিতে আসতে চান সেসকল জেলার কার্যক্রম দ্রুত করা হয়।

যাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে বিতর্ক শুরু:

গত সোমবার মৎস্যজীবী লীগের সভাপতির স্বাক্ষর ছাড়াই সাধারণ সম্পাদক লায়ন শেখ আজগর নস্করের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়। অব্যাহতি পাওয়া নেতারা হলেন—যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল আলিম, রফিকুল ইসলাম খাঁ, ফিরোজ আহমেদ তালুকদার, দপ্তর সম্পাদক এম এইচ এনামুল হক রাজু এবং উপ-প্রচার সম্পাদক ইউসুফ আলী বাচ্চু।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কোনো নিয়ম না মেনে আমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক। তার নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতেই তিনি এ কাজ করেছেন। সাধারণ সম্পাদক কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছিলাম বলেই আমাদের ওপর প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতা দেখিয়ে তার একার স্বাক্ষরে অব্যাহতি দেয়।’

আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ তালুকদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের অন্যায়ভাবে অব্যাহতি  দেওয়া হয়েছে। পদ বাণিজ্য ও বিভিন্ন অর্পকমের প্রতিবাদ করলেই অব্যাহতি দিয়ে হয়রানি করা হয় নেতাকর্মীদের। অথচ আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুমতি ছাড়া কেউ অব্যাহতি দিতে পারে না।’

দপ্তর সম্পাদক এনামুল হক রাজু ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক শেখ আজগর নস্কর দেশের বাইরে থাকায় একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশনা দেন আওযামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।’

‘তার নির্দেশে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দেয়ায় শেখ আজগর নস্করের মাইন্ডে লেগেছে। কারণ সংগঠনে তিনি একক ক্ষমতার মালিক। তিনি চান না সেই ক্ষমতার ভাগ অন্য কাউকে দিতে। তিনি ভাবেন, কাউকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিলে তার রাজনৈতিক অবস্থান নষ্ট হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শেখ আজগর নস্কর কখনো ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন কি-না বা তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে কি-না, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। কারণ যেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্দেশ দিয়েছেন, সেই নির্দেশনা পালনের জন্য সংগঠন থেকে কাউকে অব্যাহতি দেয়ার এখতিয়ার তার নেই। এই অব্যাহতির গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে না।’

এতসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আজগর নস্কর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যাদেরকে সংগঠনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।’

পদ বাণিজ্য সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব মিথ্যা কথা। আমি কোনো পদ বাণিজ্যে জড়িত না। বানানীতে আমার যে অফিস আছে সেটা ব্যবসায়িক অফিস। আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারাই দলীয় প্রভাব খাটাতে পারে না আর আমি কিভাবে প্রভাব খাটাবো?’

সংগঠনের সভাপতি সাইদুরের মগবাজারে ফ্ল্যাট কেনা এবং বির্তকিত দেলোয়ারের দেওয়া গাড়িতে চলাচলের বিষয়ে নেতাকর্মীদের বিষয়টি তিনি জানেন কি না প্রশ্নের জবাবে শেখ আজগর নস্কর বলেন, ‘আমি এসব জানি না। আর ঢাকা উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন তো নিজেই চলতে পারে না আমাদের সভাপতিকে (সাইদুর রহমানকে) কিভাবে গাড়ি দেবে?’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

(ঢাকাটাইমস/০৭অক্টোবর/ডিএম)