প্রাকৃতিক শক্তিবর্ধক ভেষজ মধুর জাদুকরী গুণ

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২২, ১১:২৭

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

প্রাকৃতিক উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন ভেষজ তরল মধু। স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং যাবতীয় রোগ নিরাময়ে মধুর গুণ অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই পারিবারিকভাবে ‘পুষ্টিকর ও শক্তিবর্ধক’ পানীয় হিসেবে মধু সব দেশের মানুষ অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে ব্যবহার করে আসছে। বিভিন্ন উপকারিতার জন্য বিশ্বের সকল দেশের মানুষ মধু খাদ্য হিসেবে, চিকিৎসা ও সৌন্দর্যচর্চাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। প্রাকৃতিক খাবার থেকে ওষুধ সবকিছুতে ব্যবহার রয়েছে মধুর।

খাদ্য ও ওষুধ হিসেবে উভয়বিধ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ মধু। মধুতে যেসব উপকরণ রয়েছে তন্মধ্যে প্রধান উপকরণ সুগার। সুগার বা চিনি আমরা অনেকেই এড়িয়ে চলি। কিন্তু মধুতে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ এ দুটি সরাসরি মেটাবলাইজড হয়ে যায় এবং ফ্যাট হিসেবে জমা হয় না।

থকথকে গাঢ় বাদামি রঙের মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ, ভিটামিন, এনজাইম, যা বিভিন্ন অসুখ প্রতিরোধ করে শরীরকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।

মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫ থেকে ১২ শতাংশ মন্টোজ। আরও থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ শতাংশ এনকাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি।

মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে অ্যালুমিনিয়াম, বোরন, ক্রোমিয়াম, কপার, লেড, টিন, জিংক ও জৈব এসিড (যেমন-ম্যালিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, টারটারিক এসিড এবং অক্সালিক এসিড), কতিপয় ভিটামিন, প্রোটিন, হরমোনস, এসিটাইল কোলিন, অ্যান্টিবায়োটিকস, ফাইটোনসাইডস, সাইস্টোস্ট্যাটিক্স এবং পানি (১৯-২১%) ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে।

ভিটামিন যেমন- ভিটামিন সি বা অ্যাসকরবিক এসিড, ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫, বি-৬, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে, ভিটামিন-এ বা ক্যারোটিন ইত্যাদি বিদ্যমান। মধু এমন ধরনের ওষুধ, যার পচন নিবারক (অ্যান্টিসেপটিক), কোলেস্টেরলবিরোধী এবং ব্যাকটেরিয়াবিরোধী ধর্ম আছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মধু ও দারুচিনির মিশ্রণ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। পিত্ত থলির সংক্রমণ রোধ করতে, বাতের ব্যথায়, মুখের দুর্গন্ধ কাটাতে, এমনকি শরীরের বাড়তি ওজন কমাতেও মধু খুবই কার্যকরী উপাদান।

এ ছাড়াও প্রতিদিন এক চামচ মধু খেলে ঠান্ডা লাগা, কফ, কাশি থেকে মিলবে দ্রুত মুক্তি। হজমের সমস্যা দূর করতে মধু খেলে উপকার পাওয়া যেতে পারে। মধুতে থাকা মিষ্টি উপাদান শরীরে শক্তি জোগায় ও শরীর কর্মক্ষম রাখে। শারীরিক দুর্বলতা দূর করে। এক কথায়, মধু শরীর-বান্ধব একটি প্রাকৃতিক উপাদান। মধু শরীরের নানান অসুস্থতা সামাল দেয়।

প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে খালি পেটে চা চামচের দুই চামচ করে মধু ডান হাতের তালুতে নিয়ে চেটে খেতে হবে। নিয়মিত ও পরিমিত মধু খেলে যেসব উপকার পাওয়া যায় তা হলো-

 

রক্ত উৎপাদন করে

মধু আয়রনের একটি ভালো উৎস। আয়রন প্রচুর পরিমাণে রয়েছে মধুতে। আয়রন ছাড়াও মধুতে কপার ও ম্যাঙ্গানিজ আছে। এই উপাদানগুলো শরীরে হিমোগ্লোবিন প্রস্তুত করতে সহায়তা করে। আয়রন রক্তের উপাদানকে (আরবিসি, ডব্লিউবিসি, প্লাটিলেট) অধিক কার্যকর ও শক্তিশালী করে। তাই রক্তশূন্যতা দূর করতে প্রতিদিন ১ চামচ মধুর সাথে পরিমাণমত লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন।

 

ত্বকের ক্ষত সারাতে

মধুতে আছে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমূহ যা সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। মধু ওজন কমাতেও সাহায্য করে । প্রতিদিন সকালে ১ গ্লাস গরম পানিতে ১ চামচ মধু মিশিয়ে পান করুন। এতে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়, এতে খাবারের ক্যালোরি দ্রুত ক্ষয় হয়। অনেকেরই শুষ্ক ত্বকে খোসা ওঠা, অস্বস্তিকর লাল ভাব এবং চুলকানি দেখা যায়। মধু এবং ‘কোল্ড প্রেস’ অলিভ অয়েলের মিশ্রণ এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।

 

পাকস্থলীর সুস্থতায়

মধু পাকস্থলীর কাজকে জোরালো করে এবং হজমের গোলমাল দূর করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্রলিক অ্যাসিড ক্ষরণ কমিয়ে দেয় বলে অরুচি, বমিভাব, বুকজ্বালা এগুলো দূর করা সম্ভব হয়।

 

সাইনাসের সমস্যায়

সাইনাস সংক্রান্ত সমস্যার কারণই হল আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং দূষণ। সংক্রমণের ফলে ভাইরাসগুলো সাইনাসগ্রন্থির পথ রুদ্ধ করে রাখে। বাতাস চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করে। শ্লেষ্মা জমে এবং আমাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে মধুতে প্রাকৃতিক ভাবে উপস্থিত অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল যৌগগুলো সংক্রমণ দূর করতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

 

মুখের ভিতর ঘা হলে

মুখের ভিতর শ্লেষাঘটিত কোনও ঘা বা ক্ষত হলে, তা চট করে সারতে চায় না। কিছু খেতে গেলেই জ্বালা করে, ব্যথা করে। মধু হল প্রাকৃতিক অ্যান্টি-বায়োটিক। তাই ঘা সারাতে ওষুধের উপর ভরসা না করে, মধু খেয়ে দেখুন।

 

উচ্চ রক্তচাপ কমায়

দুই চামচ মধুর সঙ্গে এক চামচ রসুনের রস মেশান। সকাল-সন্ধ্যা দুইবার এই মিশ্রণ খান। প্রতিনিয়ত এটার ব্যবহার উচ্চ রক্তচাপ কমায়। প্রতিদিন সকালে খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে খাওয়া উচিত।

 

দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়

চোখের জন্য ভালো। গাজরের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।

 

ওজন কমায়

মধুতে নেই কোনো চর্বি। পেট পরিষ্কার করে, চর্বি কমায়, ফলে ওজন কমে।

 

অনিদ্রায়

দীর্ঘ দিন সঠিক সময়ে না ঘুমোলে শরীর খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। ঠিকমত ঘুম না আসলে মধু এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হালকা গরম দুধে এক চামচ মধু এবং এক চিমটে হলুদ এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে

মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। এটি ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ১ চা–চামচ খাঁটি মধু ভোরবেলা পান করলে কোষ্ঠবদ্ধতা এবং অম্লত্ব দূর হয়।

 

ফুসফুসের যাবতীয় রোগে

ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু উপকারী। যদি একজন অ্যাজমা (শ্বাসকষ্ট) রোগীর নাকের কাছে মধু ধরে শ্বাস টেনে নেওয়া হয়, তাহলে সে স্বাভাবিক এবং গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিতে পারবে। অনেকে মনে করে, এক বছরের পুরোনো মধু শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বেশ ভালো।

 

তাপ উৎপাদনে

শীতের ঠান্ডায় এটি শরীরকে গরম রাখে। এক অথবা দুই চা–চামচ মধু এক কাপ ফুটানো পানির সঙ্গে খেলে শরীর ঝরঝরে ও তাজা থাকে।

 

হাঁপানি রোধে

আধা গ্রাম গুঁড়া করা গোলমরিচের সঙ্গে সমপরিমাণ মধু এবং আদা মেশান। দিনে অন্তত তিনবার এই মিশ্রণ খান। এটা হাঁপানি রোধে সহায়তা করে।

 

হৃদরোগে কার্যকর

হৃদরোগে মধু বেশ কার্যকর। এক চামচ মৌরি গুঁড়ার সঙ্গে এক বা দুই চামচ মধুর মিশ্রণ হৃদ্‌রোগের টনিক হিসেবে কাজ করে। এটা হৃৎপেশিকে সবল করে এবং এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

 

যৌন অক্ষমতা দূর করে

যৌন অক্ষমতা দূর করে এবং অটুট যৌবন ধরে রাখে। যৌন অক্ষমতা দূর করার জন্য বিশ্বের প্রখ্যাত মধু বিজ্ঞানীদের মতে দৈনিক পর্যাপ্ত মধুই যথেষ্ট। নিয়মিত মধু সেবন করলে ধাতু দুর্বল (ধ্বজভঙ্গ) রোগ হয় না।

 

খাঁটি মধু চিনে নেওয়ার সহজ উপায়

মধুকে ফ্রিজের মধ্যে রেখে দিয়ে আসল নাকি নকল তা নির্ণয় করা যায়। খাঁটি মধু জমবে না। ভেজাল মধু ফ্রিজে রাখলে পুরোপুরি না জমলেও জমাট তলানি পড়বে।

মধুর পুরুত্ব দেখার মাধ্যমে আসল মধু চেনা যায়। বৃদ্ধাঙ্গুলে সামান্য মধু নিন, যদি তা বেশ আঠালো মনে হয় তাহলে বুঝবেন এটি আসল মধু। দেখবেন দুটো হাত চিটেই থাকছে।

এক টুকরো সাদা কাপড়ে মধু মাখান। আধা ঘণ্টা রাখুন। তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। যদি দাগ থেকে যায়, বুঝবেন মধুটি খাঁটি নয়। শীতের দিনে বা ঠান্ডায় খাঁটি মধু দানা বেঁধে যায়।

মধুর স্বাদ হবে মিষ্টি, এতে কোনো ঝাঁঝালো ভাব থাকবে না। মধুতে কখনো কটু গন্ধ থাকবে না। খাঁটি মধুর গন্ধ হবে মিষ্টি ও আকর্ষণীয়।

মোমবাতির সলতে নিয়ে মধুতে ডুবিয়ে আগুন দিয়ে জ্বালানোর চেষ্টা করুন। যদি জ্বলে ওঠে, তাহলে বুঝবেন যে মধু খাঁটি। আর যদি না জ্বলে, বুঝবেন যে মধুতে পানি মেশানো আছে।

গ্লাসে বা পাত্রে খানিকটা পানি নিন। তার মধ্যে এক চামচ মধু দিন। যদি মধু পানির সঙ্গে সহজেই মিশে যায়, তাহলে বুঝবেন যে এটা অবশ্যই নকল। আসল মধুর ঘনত্ব পানির চাইতে অনেক বেশী, তাই তা সহজে মিশবে না। এমনকি নাড়া না দিলেও মধু পানিতে মিশবে না।

দুই-তিন ফোঁটা ভিনেগার এবং পানি মধুর সাথে মিশিয়ে ঝাঁকিয়ে নিন। মিশিয়ে নেওয়ার পর যদি ফেনার মতো তৈরি হয় তাহলে বুঝে নিবেন এটি নকল মধু।

হাতের তালুতে মধু নিন কয়েক ফোঁটা। যদি দেখেন যে তা অন্যান্য তরলের মতোই গড়িয়ে যাচ্ছে তাহলে ধরে নেবেন সেই মধু খাঁটি নয়। মধু খাঁটি হলে কখনই গড়িয়ে যাবে না। এক জায়গায় জমাট বেঁধে থাকবে।

(ঢাকাটাইমস/২৬ অক্টোবর/আরজেড)