প্রাতিষ্ঠানিক লাভ-লোকসানের কবলে বৈশ্বিক ক্রীড়া সাংবাদিকতা

প্রকাশ | ৩১ অক্টোবর ২০২২, ১৭:৫৬

মুকুল মুর্শেদ

বর্তমানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উন্মাদনায় মত্ত সারাবিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীরা। এই সময়টার জন্য তাদের অপেক্ষা থাকে দীর্ঘ সময়ের। আর স্টেডিয়ামের বাইরে চলে ভক্তদের আলাদা একটা উম্মাদনা। বেশিরভাগ সময় সেই উম্মাদনা দেশ, উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়ায়। আর সাধারণ ক্রীড়ামোদীদের এই উম্মাদনা হয় ব্যবসার পুঁজি। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক বড় বড় ব্যবসা। অর্থাৎ ক্রীড়াকে নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করে আয়ের ব্যবসা।

আমার মনে আছে, ২০১৫ সালে ষ্টার স্পোর্টস ইন্ডিয়া নিজেদের প্রচারণার জন্য ‘মওকা মওকা’ শিরোনামে কয়েকটি বিজ্ঞাপন বানায়। দেশে-বিদেশে বিপুল প্রচারিত এই বিজ্ঞাপনগুলো টিভি চ্যানেলটির জন্য অনেক লাভ নিয়ে আসে। বিজ্ঞাপনের লাভ লোকসানের মতোই বিশ্বসাংবাদিকতায় ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে এই ‘লাভ লোকসানের’ অঙ্কে হিসাব করা হয়।

অলিম্পিক কিংবা ফিফা বিশ্বকাপের ক্রীড়া অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়েই থাকে বিপুল উৎসাহ। এই সকল অনুষ্ঠানের জন্য অনেক আগে থেকেই সাংবাদিকরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সাংবাদিকদের এই আগ্রহের পেছনে কাজ করে মূলত খেলাকেন্দ্রিক সংবাদের গুরুত্ব।

ফলে ক্রীড়া সাংবাদিকরা বেশিরভাগ সময় ‘বিনোদনধর্মী’ সংবাদ প্রচার করে পাঠকদের প্রতি নিজের দায় সেরে ফেলে! এর ফলে ‘না পুরোপুরি খেলার খবর’ ‘না পুরোপুরি বিনোদন সংবাদ’—কোনোটাই হয় না। ফলে ক্রীড়া সাংবাদিকতার সম্ভাবনাও পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

স্বভাবতই এখন প্রশ্ন আসতে পারে—‘সম্ভাবনার’ কথা বলা হচ্ছে কেন? এই সম্ভবনা কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? আসলে ক্রীড়া জগতের চাকচিক্যের আড়ালে অনেক বিষয়ই গোপন রয়ে যায়। দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারী, মাদকসংক্রান্ত সমস্যা—কালেভদ্রে সামনে আসে। খবরে আসছে না মানে আবার এও নয় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে না। ঘটছে, কিন্তু তা সচরাচর মানুষের সামনে আসছে না।

এর কারণ হিসেবে ওই ক্রীড়া জগতের ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপটকে দায়ী করা যেতে পারে। এর ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপটের জন্যই কোন সংবাদটা গণমাধ্যমের সামনে যাবে আর কোনটা যাবে না তা বেশিরভাগ সময়েই ‘সেন্সর’ করা হয়।

এমনকি সংবাদ সম্মেলনে একজন খেলোয়াড়কে কোন প্রশ্নটা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না—তাও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে সাংবাদিকদের কাছ থেকে জনগণ যেই ‘স্পষ্টতা’ আশা করেন, সেটা তারা দিতে পারেন না।

২০১৬ সালে দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক ড্যানিয়েল টেলর একটি সংবাদ সামনে আনেন। প্রাক্তন ফুটবলার অ্যান্ডি উডওয়্যান্ড তার নিজের কোচের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। সেই ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন টেলর। এর জন্য তিনি ২০১৭ সালে ‘দ্যা সোসাইটি অফ এডিটরস প্রেস অ্যাওয়ার্ডস’ পান।

অথচ প্রশ্নটা কিন্তু কখনোই পুরস্কারের জন্য ছিল না, প্রশ্নটা হল ‘ট্রান্সপারেন্সির’। সাংবাদিকতার মূল মন্ত্রই হলো এই ‘ট্রান্সপারেন্সি’। কিন্তু তা এখন ‘ক্রীড়া সাংবাদিকতার’ ‘বানিজ্যিকীকরণের’ ফলে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।

বিশ্ব সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র হলো—বিশ্বের সব পাঠককে এক সূত্রে আবদ্ধ করা। এর একটা দায়িত্বও আছে। মানুষের সামনে সত্যকে নিয়ে আসা।

ক্রীড়া সংবাদের প্রতি স্বভাবতই সবার আগ্রহ থাকে। তাই বিশ্ব সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এর সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু আলোচ্য কিছু কারণের জন্য এখনও সেই সম্ভাবনা অংকুরেই পড়ে রয়েছে।

মুকুল মুর্শেদ

শিক্ষার্থী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়