জেল হত্যা দিবস ইতিহাসের বেদনাময় অধ্যায়

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩২

মো. খসরু চৌধুরী সিআইপি

৩ নভেম্বর বাঙালির শোকের দিন। জেলহত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে খুনিচক্র ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের যে কটি দিন চিরকাল কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি ৩ নভেম্বর। এর আগে ১৫ই আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জেলহত্যা ছিল সেই হত্যাকাণ্ডেরই ধারাবাহিকতা।

একাত্তরের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন জাতির সেরা সন্তান জাতীয় এই চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়েছিল। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় বর্বরোচিত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত এবং তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের প্ররোচনায় এক শ্রেণির উচ্চাভিলাষী মধ্যম সারির জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা এ নির্মম হত্যাকান্ড ঘটায়। জাতীয় এ চার নেতা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে আটক বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন। বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে।

পরে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের সমধিক পরিচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কোটি কোটি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর অপর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি ও কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৮২ দিন। এরই মধ্যে দেশকে পাকিস্তানিকরণের দিকে এগিয়ে নেওয়া ছাড়া তার সবচেয়ে বড় দুটি কুকীর্তি হলো জেলে জাতীয় চার নেতাকে খুন এবং ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার করা যাবে না এমন দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করা। পঁচাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি এই অধ্যাদেশ জারি করেন। আর জেলে নির্মম হত্যাকান্ড ঘটান ৩ নভেম্বর ভোর রাতে।

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম গৌরব এই স্বাধীনতাযুদ্ধ। কিন্তু পরাজিত শক্তি থেমে থাকেনি। সদ্যঃস্বাধীন দেশে নানা রকম চক্রান্ত চালিয়ে যেতে থাকে। তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ট্যাংক, কামান ও মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিল তারা। বাধ্য হয়ে বাঙালি জাতিও অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

সেই যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সেই যুদ্ধে বাঙালি বিজয়ী হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হেরে যায় তাদের এ দেশীয় দোসররাও। তারাই পরবর্তীকালে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এই হত্যাকাণ্ড শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারাগারের নিরাপত্তানীতি ভেঙে রাতের অন্ধকারে এভাবে জাতীয় নেতাদের হত্যার ঘটনা বিশ্বে বিরল।

দুঃখের বিষয়, জেলহত্যার পর দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখলে রেখেছিল খুনিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষ। তারা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল হত্যা মামলার বিচার। সুপরিকল্পিতভাবে অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর মামলার প্রক্রিয়া আবার চালু করা হয়।

২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর নিম্ন আদালত থেকে মামলার রায় পাওয়া যায়। রায়ে তিনজনের মৃত্যুদণ্ডসহ ১৫ জনের সাজা হয়। এরপর মামলা যায় হাইকোর্টে, পাওয়া যায় হাইকোর্টের রায়; যদিও সাজাপ্রাপ্তদের অনেকেই পলাতক কিংবা বিদেশে অবস্থান করছে। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অপরাধে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। যেসব আসামি এখনো পলাতক, দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং রায় কার্যকরের মাধ্যমে ইতিহাসের আরেক কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে।

জেল হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের একটি নৃশংসতম ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করেছে সুদূরপ্রসারী হীন উদ্দেশ্য ও ষড়যন্ত্র। দেশকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, দেশকে রাজনীতিহীন করার একটা অপচেষ্টা ছিল ঘাতকচক্রের। কেমন করে রাতের অন্ধকারে কারাগারের নিরাপত্তা ভেদ করে ঘাতকচক্র অস্ত্র হাতে কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করল, সেটা আজো একটি বড় প্রশ্ন।

একটি দেশের জাতীয় নেতাদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় আজও কার্যকর না হওয়া দুঃখজনক। জাতির পিতার হত্যার বিচার হয়েছে কিন্তু সেখানেও পলাতক আসামীদের সাজা কার্যকর হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে ও আশ্রয়ে থাকা আসামীদের দেশে আনার ব্যাপারে সরকারে উদ্যোগ থাকলেও কার্যকারিতা দৃশ্যমান নয়। আমরা মনে করি দ্রুতই এইসব খুনিদের শাস্তি কার্যকর করতে না পারলে আইনের শাসন মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

লেখক: রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ; চেয়ারম্যান, নিপা গ্রুপ ও কেসি ফাউন্ডেশন।