বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০২২, ০৮:০৫
বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায় ৩ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনাসদস্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। তারপর তার ঘনিষ্ঠ চার সহকর্মী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী যুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানকে কারাগারে পাঠানো হয়। একই বছর ৩ নভেম্বর আবারো একদল সেনাসদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারপর থেকে রাষ্ট্রের হেফাজতে হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনাটি ‘জেলহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। কিন্তু তার সুযোগ্য সহকর্মীরা জনগণকে নিয়ে ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। এটাও ছিল বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব। কারণ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে যান। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একটি দেশের প্রায় সব নাগরিককে একজন নেতার নেতৃত্বে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দ্বিতীয় নজির খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ সালে পিওন, মুটে-মজুর থেকে উচ্চ আদালতের বিচারপতি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। সামরিক আইন ও সরকার বহাল থাকা অবস্থায় ১৯৭১-এর ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়।
স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাকে হত্যা করে। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত সত্য যে, যারা পরিবারের সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, তারাই চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছে। জাতির পিতা হত্যার পর চার নেতা হত্যার বিষয়টি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যই ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। জাতির পিতাকে হত্যা করে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করা হয়। ঘাতকচক্র জানত, শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হবে না।
ইতিহাসের এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে তখনকার উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে পুরোপুরি জড়িত ছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমদকে শিখন্ডী বানিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে জিয়াউর রহমানই এ ষড়যন্ত্রে সব কলকাঠি নেড়েছেন, তা এখন সর্বসত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। এই সরকার পুরোপুরি সেনা সরকার ছিল না। এদিকে জাতির পিতার হত্যাকারী রশিদ, ফারুক ও তার কয়েকজন সহযোগী ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গভবনে অবস্থান নেন। মোশতাক ও তার সরকারের ওপর এই খুনিদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এ নিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ।
এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারিয়ে দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে। জাতির বিশ্বাস ছিল- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান জাতিকে আগের ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। কেননা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বাঙালির পরম নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন তারা। এসব বুঝতে পেরেই সেনা অভ্যুত্থানকালে জেলখানায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর চার বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে। স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ও মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ও মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিমের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ঘৃণ্যতম এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং তার সহযোগীরা।
জেলহত্যার পর ২১ বছর পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলার রায় দেন। রায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ, আহমদ শরিফুল হোসেন, কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন।
জেলহত্যা মামলার ১০ জন আসামি এখনো পলাতক। তারা হলেন- মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মোসলেম উদ্দিন, আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধা, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, কিসমত হোসেন ও নাজমুল হোসেন আনসার। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুল মাজেদ দেশের বাইরে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২৯ বছর পর জেলহত্যার বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবার এ রায়কে মেনে নেয়নি। তারা এ রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায়’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
জাতীয় চার নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও চেতনাকে নির্মূল করা। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ সুদীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র এবং তাদের হত্যার রাজনীতিকে পরাজিত করেছে। যে সেলটিতে চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানকার রডে এখনো রয়েছে গুলির ক্ষত। সেই গুলির চিহ্ন সংরক্ষণ করে সেলটিকে বানানো হয়েছে জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর। ওই সেলের খানিকটা দূরে রয়েছে বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘর।
২০১০ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতিবিজড়িত কারা জাদুঘর উদ্বোধন করেন। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা-২ অধিশাখা এক প্রজ্ঞাপনে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার স্মৃতি জাদুঘরকে জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে ঘোষণা দেয়।
১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী যে চক্র জেলের ভেতরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সে চক্রের অপতৎপরতা আজও থেমে নেই। এখনো তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এখন তারা দেশের ভেতরে স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তমনা প্রকাশকদের হত্যা শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সকল পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। এর পাশাপাশি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই চার নেতার প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়