দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার সেই কর্মকর্তার জীবন এখন অর্থসংকটের যাঁতাকলে

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০২২, ০৯:২৯

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশের মানুষের বাহবা পেয়েছেন। মূল ধারার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে তার বিভিন্ন অভিযানের সংবাদ। অথচ যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন আজ তাদেরই নানা হুমকির শিকার হচ্ছেন।

এদিকে পরিবারে অর্থ সংকট। বয়োবৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসা, সন্তানদের খাবার- কিছুই আর আগের মতো চলছে না। ভাইয়ের চাকরিতেও বাধা। সবমিলিয়ে তীব্র মানসিক যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে দিন কাটাতে হচ্ছে।

এই গল্প দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত সেই আলোচিত উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের। চাকরি হারিয়ে নয় মাস ধরে আর্থিক অনটনে দিনাতিপাত করছেন দুদকের সাবেক এই কর্মকর্তা।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শরীফ তার বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। অর্থাভাবে অসুস্থ মায়ের জন্য এক কেজি ফলও কিনতে পারেন না তিনি। সন্তানের এই পরিস্থিতি দেখে দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন তার বয়োবৃদ্ধ মা।
চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেই আদেশে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা-২০০৮ এর বিধি ৫৪ (২)তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পটুয়াখালীতে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দীনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তবে সেই নোটিশে চাকরিচ্যুত করার নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়নি।

শরীফের চাকরি ফেরত দিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। জাতীয় সংসদেও তার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। এমনকি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুদক কর্মকর্তারা তার জন্য মাঠে নেমেছিলেন। এতো কিছুর পরও চাকরি ফেরত পাননি শরীফ উদ্দিন।

চট্টগ্রামে দুদকের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে শরীফ উদ্দিনের অভিযানে তটস্থ থাকতো দুর্নীতিবাজরা। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান চালিয়ে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন। তার বিভিন্ন অভিযান নিয়ে প্রধান সংবাদের শিরোনাম হতো দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে। তবে ‘রহস্যজনকভাবে’ দুদক তাকেই চাকরিচ্যুত করে। অভিযোগ আছে, প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়ে দুদক থেকে চাকরি হারাতে হয় শরীফকে। এরপর অনেক চেষ্টার পরও চাকরি ফেরত পাননি।


শরীফ উদ্দিন জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর থেকেই চাকরি ফিরে পেতে অনেকের কাছে গেলেন। অনেকেই আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। চাকরি নেই নয় মাস হয়ে গেছে। বাবা তুমি অফিসে যাচ্ছো না কেন- সন্তানদের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না তিনি।
শরীফের বয়স এখন ৩৫ বছর। এই বয়সে সরকারি চাকরিতে আবেদনও করার সুযোগ নেই। জানালেন, বেসরকারি চাকরিতে আগের মতো মানসিক শক্তি নিয়ে যোগ দেওয়াও অনেক কঠিন। পরিবার নিয়ে এখন মানসিক ও আর্থিকভাবে অনেক কষ্টে আছেন। দিন শেষে মায়ের জন্য এক কেজি ফল আনতে পারেন না। সন্তানদের জন্য আগের মতো চকলেট আনতে পারেন না। ছেলে দুরবস্থা দেখে দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন শরীফের বয়োবৃদ্ধ মা। দুদিন আগেও মাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে শরীফবে। দুশ্চিন্তা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।  ভাইবোনেরাও শরীফকে নিয়ে চিন্তিত।

এক সময়ের আলোচিত দুদক কর্মকর্তা শরীফের বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। সেখানে কিছু পেনশনের টাকা শরীফের ভাগে পড়ছিল। এখন সেগুলো খরচ করছেন। মায়ের ভাগেরটাও খরচ করছেন শরীফ। কিন্তু সেগুলো দিয়ে আর কতোদিন যাবে। দুই সন্তান স্কুলে যাচ্ছে। তাদের পেছনেও নিয়মিত খরচ করতে হয়।

শরীফের আক্ষেপ, এখন আগের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না। কারণ চাকরি না থাকার বিষয়টি গণমাধ্যমের সংবাদের কারণে সবার কাছে জানা এখন। সমাজের মানুষ ধরে নিচ্ছে, অন্যায় করার কারণেই তার চাকরি গেছে। বিষয়টি শরীফের পুরো পরিবারকেই পীড়া দিচ্ছে। এছাড়া দুর্নীতির কারণে দুদকের এই কর্মকর্তা যাদেরকে আইনের আওতায় এনেছিলেন, তারাই এখন শরীফকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। শরীফের চাকরি হারানোর ঘটনার কারণেই পোষ্য কোটা থাকার পরও রেলওয়েতে তার ছোট ভাইয়ের চাকরি আটকে আছে। কারণ রেলওয়েতে থাকা অবস্থায় শরীফ সেখানকার বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন।  

চাকরি ফেরত পেতে এখন কী করছেন- জানতে চাইলে শরীফ উদ্দীনের ভাষ্য, চাকরি ফেরত পেতে তিনি হাইকোর্টে রিট করেছেন। সেটা এখন আপিল ডিভিশনে আছে। শিগগিরই রায় পাবেন বলে আশাবাদী। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতির দিকে তাকিয়ে আছেন। দেশের মানুষের দোয়া আর গণমাধ্যম কর্মীদের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন দুদকের সাবেক এই কর্মকর্তা। চাকরি ফেরত পাবেন বলে এখনও প্রত্যশার প্রহর গুণছেন শরীফ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা বলেন, শরীফ উদ্দিন একজন চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসক নেতাসহ বিভিন্ন পেশার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে অভিযান চালিয়েছিলেন। মূলত এসব কারণেই তিনি প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েছেন।

এই কর্মকর্তা বলেন, শরীফের যদি দোষ থাকতো তাহলে তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারতো কর্তৃপক্ষ। অথবা আগে কারণ দর্শানোর নোটিস দিতে পারতো। কিন্তু তার কিছুই করা হয়নি। শুধু দুদকের চাকরিবিধির কথা বলা হচ্ছে। তবে সবকিছুর উপর তো দেশের সংবিধান। সেই সংবিধানের ১৩৫(২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে) নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না।’

(ঢাকাটাইমস/০৩নভেম্বর/এএ/কেএম/ডিএম)