ইসলামে ভ্রমণের গুরুত্ব

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১৮:১৮ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৫০

ড. মো. শাহজাহান কবীর

ইসলামে ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। ভ্রমণ মানুষের জ্ঞানের দুয়ার খোলে দেয়। ভ্রমণের মাধ্যমে ভিন্ন ভাষার ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কের সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। ভ্রমণ আমাদের মন উদার করে, চোখ খুলে দেয়। চেনা জগতের ছোট পরিসর থেকে নিয়ে যায় বিশাল ময়দানে।পবিত্র কুরআনে তেরো বারের বেশী ভ্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

মূলত সফরের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের নানা বৈচিত্র্য বিষয় অবলোকন করে জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করা খুবই সহজ। সফরের কারণে মানুষের সত্য, সঠিক পথ ও পন্থা গ্রহণে সহায়ক হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তবে কি তারা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে না, যাতে তাদের অন্তর অনুধাবন করতে পারত এবং তাদের কান সত্য কথা শুনে নিত।’ (সুরা হজ, আয়াত- ৪৬)

নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে বের না হলে সৃষ্টিজগতের অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। পৃথিবীর একেক স্থান একেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি সেসব স্থানে চিন্তাশীলদের জন্যও রয়েছে চিন্তার খোরাক। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘বলে দাও, তোমরা ভূপৃষ্ঠে ভ্রমণ করো এবং দেখো, কিভাবে আল্লাহ প্রথমবারে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনি শেষবারেও সৃষ্টি করবেন।’ (সুরা  আনকাবুত, আয়াত - ২০)

এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘বলো, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো, তোমাদের আগের লোকদের কী পরিণাম হয়েছিল! তাদের বেশির ভাগই ছিল মুশরিক।’ (সুরা- রুম, আয়াত- ৪২)

বর্তমানে ব্যবসা, শিক্ষা, বিনোদন, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ ভ্রমণ করে। এসব সফরও যদি কুরআনের নির্দেশের কথা স্মরণ করে ইবাদতের উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে পার্থিব কল্যাণের পাশাপাশি আখিরাতের জন্য সওয়াবও অর্জিত হবে।

পর্যটন হলো জ্ঞানসমুদ্রের সন্ধান। প্রফুল্ল মন ও শারীরিক সুস্থতার জন্য মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করা খুব উপকারী। ভ্রমণ মানুষের মনের পরিধিকে বিস্তৃত করে।বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন, ভ্রমণ স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য জানায়, ভ্রমণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। মহান আল্লাহর বিশাল সৃষ্টি দর্শন, জ্ঞান আহরণ, রোগ নিরাময় এবং আত্মশুদ্ধির জন্য ভ্রমণ করার নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। কেউ যদি সওয়াবের নিয়তে ভ্রমণ করে, পুরো ভ্রমণেই তার সওয়াব অর্জন হবে। জ্ঞানার্জনের জন্য স্বামী-স্ত্রী সপরিবারে বা দলবদ্ধভাবে ভ্রমণে বা পর্যটনে যাওয়ায় কল্যাণ ও পুণ্য নিহিত রয়েছে। পৃথিবীজুড়ে রয়েছে আল্লাহর কুদরতের নানা কীর্তি। এসব দেখে মানুষ চিন্তা ও গবেষণা করবে। দৃঢ় করবে ঈমান ও আমল। 

ভ্রমণ ও চলাচল মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের ভ্রমণ করতে বলেছেন, যেন তারা সৃষ্টিজগতে বিদ্যমান আল্লাহর অসীম কুদরত দেখতে পারে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সড়ক বা ভ্রমণ দুর্ঘটনার বাহ্যিক বিভিন্ন কারণ আছে। কিন্তু ধর্মীয় পণ্ডিতরা এর কিছু ধর্মীয় কারণও উল্লেখ করেছেন। সড়ক বা ভ্রমণ দুর্ঘটনার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, প্রথমত, মৃত্যু সৃষ্ট জীবের অনিবার্য নিয়তি ও পরিণতি। ইসলামী বিশ্বাস মতে, নির্দিষ্ট সময়েই মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু পৃথিবী যেহেতু দারুল আসবাব বা কারণ-উপকরণের প্রকাশস্থল, তাই কারো মৃত্যুর জন্য ভ্রমণ দুর্ঘটনা বাহ্যিক উপলক্ষ ছাড়া আর কিছুই নয়।

দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে যখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না, অপরাধী মানুষ আল্লাহর ভূখণ্ডে অবাধে বিচরণ করে তখন তারা যেকোনো সময়েই ভয়াবহ আজাবে নিপতিত হতে পারে। আল্লাহর আজাব এলে অপরাধী-নিরপরাধী সবাই আজাবে পতিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা পাপাচার ও অপকর্মের ষড়যন্ত্র করে তারা কি এ বিষয়ে নির্ভয় হয়ে গেছে যে আল্লাহ তাদের ভূগর্ভে ধসিয়ে দেবেন না, কিংবা এমন দিক থেকে শাস্তি আসবে না, যা তাদের ধারণাতীত? কিংবা তিনি তাদের পাকড়াও করবেন, যখন তারা চলাফেরা করতে থাকবে।’ (সুরা নাহল, আয়াত- ৪৫, ৪৬)

তৃতীয়ত, রাসুলে পাক (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘যখন সমাজে জিনা-ব্যভিচার বেড়ে যাবে তখন তাদের মধ্যে মৃত্যু ব্যাপক হয়ে যাবে...যখন বিচারকার্যে অবিচার করা হবে তখন তাদের মধ্যে খুনখারাবি ছড়িয়ে পড়বে।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)

রাসুলে পাক (সা.) ভ্রমণে সঙ্গী-সাথীর সংখ্যা সম্পর্কেও নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘একজন কিংবা দুইজন সঙ্গীর চেয়ে তিনজন সঙ্গী অধিক উত্তম। তিনজনের ভ্রমণকে কাফেলা বলা হয়। একজন কিংবা দুইজনের ওপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে পারে, কিন্তু তিনজনের ওপর সম্ভব হয় না।’ (তিরমিজি )

তিনি তিনজনের সফরে একজনকে দলনেতা নির্বাচন করতে বলেছেন। তিনি এরশাদ করেন, ‘যখন একসঙ্গে তিনজন ভ্রমণে বের হবে, তখন একজনকে নেতা নিযুক্ত করবে।’ (আবু দাউদ )

ভ্রমণ কেবল মানুষকে নতুন কিছু দেখায় না, নিজেকে ও সঙ্গী-সাথীদের চিনতে সাহায্য করে। ভ্রমণের কারণে মানুষ ধৈর্যশীল হয়, সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক আবু রায়হান মুহাম্মদ আলবেরুনি যখন ভারতে জ্ঞান অন্বেষণে আসেন, তখন এই অঞ্চলের মানুষের সংকীর্ণতা ও অহমিকা দেখে অবাক হয়ে যান। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন যে, এই অঞ্চলের মানুষ ভারতভূমির বাইরে কোথাও যান না।

ভ্রমণের সবচেয়ে উপকারী দিক হলো অভিজ্ঞতা। হযরত মুআবিয়া (রা) বলেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রজ্ঞাবান হওয়া যায় না। যদিও সাবধানতা গ্রহণ করা উচিৎ, তবু বলতে বলতে হয় ভ্রমণে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে পরিচিত হতে হয়, এরমধ্যে অনেক প্রতারকও থাকে, কখনো কখনো তাদের খপ্পরে পড়ে যেতে হয়, সেখান থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। হাদিসে আছে, আল্লাহর রসুল (স) বলেন, মুমিন এক গর্তে দুই বার দংশিত হয় না। (বুখারি) ইসলাম প্রতারিত হওয়াটাকেও শিক্ষায় রূপান্তর করতে বলে।

ভ্রমণের অনেক নিয়মকানুন আছে, অবস্থান বোঝে নিয়মকানুন ভিন্ন হয়, সেগুলো মান্য করা। বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করা। ভ্রমণে বের হওয়ার আগে আল্লাহর রসুল (স) এই দোয়া করতে বলেছেন— আল্লাহর নামে বের হচ্ছি আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো উপায় নেই  আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তিও নেই।’ (তিরমিজি)

আল্লাহ আমাদের বেশি বেশি ভ্রমণ করার এবং ভ্রমণ থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি