মানুষ অস্তিত্বগত ভাবেই সমাজবিরোধী জীব

প্রকাশ | ০৬ নভেম্বর ২০২২, ১৭:৩৪

শারমিন সালসাবিল খান

মানুষ অস্তিত্বগত ভাবেই সমাজবিরোধী জীব। নফস বা প্রবৃত্তির ক্ষুধা নিবারণে উন্মত্ত। পাগলা ঘোড়ার মতোন ভারসম্যহীন। নফস চায় অন্যকে দুমড়ে মুচড়ে নিজের খায়েশকে পরিপুষ্ট করতে। সে যে কোনো অজুহাতেই হোক। অ্যাকশন সিনেমার দর্শকপ্রিয়তা কিংবা অ্যাকশন গেমগুলোর জনপ্রিয়তা তার উদাহরণ হতে পারে। মানুষের ভেতরের আদিতম প্রবৃত্তিকে মুক্ত করতে কার না ভালো লাগবে? আর যখন প্রত্যেকটা মানুষই তার আদিতম প্রবৃত্তিতে ফিরবে, সেটা কেমন সমাজ?

ধর্মের জায়গা এখানেই। প্রবৃত্তিতে মগ্ন সত্তাগুলোকে বিশেষ কাঠামোতে আনার পাটাতন দেয়া। অদৃশ্য বিচারক ও তার বিচারব্যবস্থা দিয়ে ব্যক্তির প্রবৃত্তিকে সাধ্যমতো আটকে রাখা। বাসযোগ্য সমাজ তৈরি করা। নাহ, প্রবৃত্তিধারী যে যে বিষয় নিয়ে উন্মত্ত, ধর্ম তাদের একেবারেই ব্যান করবে না। বিশেষ চ্যানেল তৈরি করে সেই চ্যানেল দিয়ে বাহিত করবে। যেমন যৌনতার ইস্যুতে ধর্ম বিশেষ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করবে, যেন সমাজ স্ট্যাবল থাকে। তার নাম দেয়া হবে বিয়ে। অবশ্যই বিয়ে কেবল যৌনতার প্রতিকার না। অনেক কিছুর। যাহোক, বিয়ের প্রক্রিয়া কেমন হচ্ছে, সেটা সেই পরিবেশ নির্ধারণ করে।

সামাজিক চুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে। তবে, এখন অব্দি রাষ্ট্রহীন বহু জাতিগোষ্ঠী দেখা গেছে, ধর্মহীন পাওয়া যায়নি। সে দূরপ্রাচ্যে হোক কিংবা আফ্রিকার গভীর অরণ্যে। যে কোনো জাতিতে রাষ্ট্র জন্ম নেয়ার আগে ধর্ম সেই দায়িত্ব পালন করে। অদৃশ্য চুক্তির কাজ করে। সীমালঙ্ঘনকারী জাহান্নামে যাবে। শরাব দুনিয়ায় নিষেধ। অথচ কেউ দুনিয়ায় খেয়ে অশান্তি তৈরি না করলে জান্নাতে ঠিকই পাবে। ফলে শরাবের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভারসাম্য।

ফলে এইটুকু অনুসিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, ধর্মের মৌলিক কাজই ঐক্য, সমাজ, উম্মাহ গঠন। ধর্ম যখন ঐক্য তৈরির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, তখন তার মৃত্যু অনিবার্য। পৃথিবীর যে প্রান্তে যে ধর্মটা টিকে আছে, তা এর মধ্য দিয়েই টিকে আছে। যা বিলুপ্ত হয়েছে, তা এ কারণেই হয়েছে। মানুষ যেহেতু সমাজবিরোধী, সমাজ গঠনের জন্য ধর্মকে মধ্যস্থতা করতে হয়। তৈরি করতে হয় কমান্ডমেন্ট। খুন করো না, মদ খেয়ো না, কারো হক নষ্ট করো না, জেনা করোনা, ওজনে কম দিওনা, চুরি করো না কিংবা কাউকে ঠকিও না। সর্বোপরি ব্যক্তিকে প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে।

প্রবৃত্তির পরিচয় কী? প্রবৃত্তির জন্ম ’আমিত্ব’ বোধ থেকে। যার মধ্যে আমিত্ব যতো শক্তিশালী, সে ততো প্রবৃত্তিপরায়ণ। ততো স্বার্থপর। সমাজের জন্য ততো ভয়ানক। তবে এই আমিত্ব বেশ ট্রিকি একটা বিষয়। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জনাব ক জনাব খ-কে  ঠকালো। এইটা আমিত্বের প্রথম স্তর। আবার জনাব ক জনাব খ-কে ঠকায়নি। এই না ঠকানো তাকে আনন্দিত করল। এইটা আমিত্বের দ্বিতীয় স্তর।

এখন এই যে আমিত্বের দ্বিতীয় স্তর খুঁজে বের করার একটা জ্ঞানগত তৃপ্তি, এইটা আমিত্বের তৃতীয় স্তর। এইভাবে অন্তহীন স্তর হতে পারে আমিত্বের। ফলে প্রবৃত্তিরও স্তর অনেক। অধিকাংশ সময় প্রবৃত্তিই সাদা পোশাক পরে সামনে এসে দাঁড়ায় ও বিভ্রান্ত করে। আমিত্বের টিকে থাকতে হলে শত্রু প্রয়োজন। এইজন প্রতিনিয়ত সে কাউকে শত্রু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে থাকবে। কাউকে মারতে হবে, কাউকে খেদাতে হবে, কাউকে ঘরছাড়া করতে হবে। কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে হলেও মূলত ‘আমিত্ব’ সেই কাজের নেতৃত্ব দেয়।

যখন আমিত্ব ও প্রবৃত্তির অপসারণ ঘটে। তখন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সমান হয়ে যায়। আপাত চোখে তার মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু যে আমিত্ব থেকে বের হয়েছে, সে সব কিছুতে মিশে গেছে। প্রকৃতির শুরু ও শেষ নেই। ওই আমিত্বহীনেরও তখন শুরু ও শেষ থাকে না। নদী সমুদ্রে মিশলে আপাত চোখে নদীর মৃত্যু ঘটে। বাস্তবিক অর্থে নদী সমুদ্রে পরিণত হয়। লাভ করে সমুদ্রের স্বচ্ছতা, সমুদ্রের গর্জন, সমুদ্রের গভীরতা।

লেখক: সরকারি কর্মকর্তা