ভোক্তা অধিকার আইনে আসছে সংশোধনী, জরিমানা দ্বিগুণ করার প্রস্তাব, বাড়বে শাস্তিও

অভিজিত রায় কৌশিক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর ২০২২, ১১:৪৭

সরকার নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত আদায়, নিবন্ধন না থাকা, নোংরা পরিবেশে মানহীন ভেজাল পণ্য উৎপাদন বাজার সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন অপরাধে জেল জরিমানার পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে চেষ্টা করছে সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

বাজারে নৈরাজ্য ফেরাতে বর্তমানে চলমান ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ অনুযায়ী যে জরিমানা বা দণ্ডের বিধান রয়েছে তা অপরাধ অনুযায়ী যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। তাই আইনের সংশোধন করে জরিমানার পরিমাণ দ্বিগুণ ও শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। সেই সঙ্গে নতুন আইনের প্রস্তাবনার খসরা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলেও নতুন করে সংশোধনের জন্য কেবিনেট থেকে ফেরত এসেছিল। তবে সংশোধনের পর আবারও পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে ভোক্তার চাওয়া-পাওয়া যৌক্তিকভাবে দেখছে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)।

এএইচএম সফিকুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘২০০৯ সালের আইনে যে জরিমানা ও শাস্তির বিধান ছিল নতুন আইনে অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ করা হচ্ছে। আমরা প্রস্তাবনা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম অনেক দূর কাজও হয়েছিল। কিন্তু কেবিনেট থেকে অবজারবেশন দিয়ে ফেরত এসেছিল। আমরা সংশোধন করে আবার সেটা পাঠিয়েছি। এই খসরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কেবিনেটে যাবে, সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে পার্লামেন্টে যাবে।’

তিনি বলেন, নতুন প্রস্তাবনা অনুমোদন হলে জরিমানা বা শাস্তির ব্যাপ্তি বাড়বে। আর এগুলোর ব্যাপ্তি বাড়লে যাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি তাদের যদি আরও কঠোর জায়গা নিতে পারি তাতে অপরাধ কমবে এবং ভোক্তাদের লাভ হবে।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, জরিমানা বৃদ্ধি করা হোক আর শাস্তি হোক এটা আমরা চায় না। আমরা চাই মানুষের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন কাজ যেন কোন ব্যবসায়ী না করে। জরিমানা বা শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি এটা মানুষ যাতে এই ধরনের অপকর্ম না করে সেই ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থায় যত কঠোর হবে ততো ভালো। তবে আইনে কঠোর হব কিন্তু প্রয়োগ হবে না তাহলে কিন্তু কোন লাভ নাই। কোন অপরাধে যদি জীবনহানি হয় তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।

এই যে শাস্তি বৃদ্ধি এবং জরিমানা বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনা এবং আইনকে কঠোর করার যে উদ্যোগ এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে সেই সঙ্গে এটা বলতে চাই এর প্রয়োগ যেন সুষ্ঠুভাবে হয়। বিনা অপরাধে কেউ যেন শাস্তি না পায়।

শাস্তি প্রয়োগের বিষয়ে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ভোক্তা অধিকার আইনটা বিশেষ আইন। অনেক সময় ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যায় না। ভোক্তা অধিকারকে আইন বলে ক্ষমতা দিলে কারোর আপত্তি করার কোনো কারণ নাই।

এদিকে নতুন প্রস্তাবনা আইনের বিষয়ে গতকাল সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ অবহিতকরণ’ করতে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, আমাদের জনবল সংকট রয়েছে তবু আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি। সারাদেশে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি অভিযান করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের বাজার এতটা বিস্তৃত, এর ১০ গুণ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তা যথেষ্ট নয়। ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ অনুযায়ী আমরা যে জরিমানা বা দণ্ড দিচ্ছি তা অপরাধ অনুযায়ী যথেষ্ট নয়। ভোক্তা অধিকারের নতুন আইন আরও কঠোর করা হচ্ছে। যেসব অপরাধে জরিমানার বিধান রয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশ দ্বিগুণ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান আইনে শাস্তি যথেষ্ট নয়, সেজন্য আরও অনেক আইন করা হচ্ছে। তবে জরিমানার পরিমাণগুলো দ্বিগুণ করা হচ্ছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রসাধনীর ক্ষেত্রে প্রতারণার বিষয়টা ভয়াবহ। কেননা বৈধভাবে এ ব্যবসায় ব্যবসায়ীদের অনীহা আছে। সঠিক পরিমাণে ভ্যাট দিয়ে, অন্যান্য সব ঠিক রেখে বৈধভাবে ব্যবসা করে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না বলছেন অনেকে। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরেও কিছু প্রোডাক্ট তৈরি করা হচ্ছে।’ সফিকুজ্জামান বলেন, ‘অনেকেই চান ভোক্তা অধিদপ্তর সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। কিন্তু আমরা এখনো সেভাবে প্রস্তুত না। প্রশাসনিক আইন জুডিশিয়াল আইন নয়। আইন কঠোর হওয়া প্রয়োজন এবং আমরা সেই চেষ্টা করছি। ভোক্তা অধিদপ্তরের অফিসাররা মাজিস্ট্রেট নন, তাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। তারা শুধু এ আইনে জরিমানা করতে পারেন। মামলা করতে পারেন বাদী হয়ে। নিজে শাস্তি দিতে পারেন না।’

সভাপতিত্ব বক্তব্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘দিনশেষে আমরা সবাই ভোক্তা। বাজারে পণ্য কিনতে গেলে আমাদের নিজের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে। আইনে কী আছে, সেটা জানতে হবে।’ ভোক্তা আইনটি এখন সংস্কার প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তবে এ সংস্থা এখন ভালো কাজ করছে, প্রতিষ্ঠানটি কোনো দল দেখে না। প্রতিষ্ঠানের মালিক কে সে খোঁজ নেয় না। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়। ভোক্তাকে আরও সচেতন হতে হবে। প্রতারিত হলে অভিযোগ দিতে হবে।’

এদিকে ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বাজারে অভিযান পরিচালিত হয়েছে ৩ হাজার ৩৪১টি। অভিযানে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজার ৯৩৩টি। বাজারে এসব অভিযানের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৬ কোটি ৫৪ লাখ ২৭ হাজার ৯০০ টাকা।

একই সময়ে ভোক্তার দেওয়া অভিযোগেরভিত্তিতে অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দণ্ডিত করা হয়েছে ৪০৭টি প্রতিষ্ঠানকে। অভিযোগের মাধ্যমে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠান থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৩৩ লাখ ৩ হাজার ৫০০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, অভিযোগেরভিত্তিতে আদায়কৃত অর্থের ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে প্রদান করা হয়। সে হিসাবে ৭ লাখ ৮০ টাকা পেয়েছেন ৩৯৬ জন অভিযোগকারী।

এছাড়া একই সময়ে ভোক্তার কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে চালানো অভিযান এবং বাজার তদারকির মাধ্যমে দণ্ডিত করা হয়েছে মোট ৭ হাজার ৩৪০টি প্রতিষ্ঠানকে। যা থেকে মোট জরিমানা আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৮৭ লাখ ৩১ হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে অভিযোগেরভিত্তিতে আদায়কৃত অর্থের ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীর প্রদানের পর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মোট জমা হয়েছে ৬ কোটি ৭২ লাখ ৯০ হাজার ৭৭৫ টাকা।

সরকার নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত আদায়, নিবন্ধন না থাকা, নোংরা পরিবেশে মানহীন ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও পরিবেশনের অভিযোগ রয়েছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে মুদি দোকানসহ নিত্যপণ্য বিক্রয়কারী পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান, কারখানা ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিন মাসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পৃথক অভিযান চালিয়ে ৭ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পরিচালিত অভিযানে নানা অনিয়মের অভিযোগে ৪২টি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর মধ্যে ৩০টিরই নিবন্ধন নেই। সে হিসেবে নিবন্ধনহীন রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।

এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল আলম, প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়ন উপ-কমিটির আহ্বায়ক ভানু রঞ্জন চক্রবর্তী।

(ঢাকাটাইমস/১১নভেম্বর/কেআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :