উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনা: প্রতিবেদন দিতে বিশেষজ্ঞদের মতামতের অপেক্ষা
রাজধানীর উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) স্থাপনা প্রকল্পের গার্ডার পড়ে শিশুসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনার মামলায় পুলিশ এখন বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই মতামত পেলেই মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হবে। ক্রেন থেকে ১২০ টন ওজনের গার্ডার ছিটকে প্রাইভেটকারে পড়ার ঘটনার ১২টি কারণ চিহ্নিত করেছে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি।
চলতি বছরের ১৫ আগস্ট বিকালে রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডার চাপায় প্রাইভেটকারে থাকা শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন। নিহতরা হলেন- হৃদয়ের বাবা আইয়ুব আলী হোসেন ওরফে রুবেল, রিয়ার মা ফাহিমা আক্তার, খালা ঝর্ণা আক্তার ও তার দুই শিশু সন্তান জান্নাতুল এবং জাকারিয়া।
এ ঘটনায় নববধূর মামা মো. আফরান মন্ডল বাবু বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় ওই দিন রাতে অবহেলাজনিত কারণে গুরুতর আহত ও মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ক্রেনটির চালক, বিআরটি প্রকল্পের চাইনিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে দায়িত্বপ্রাপ্ত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। মামলাটির তদন্ত করছেন উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়াসিন গাজী।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ঘটনার দিন দক্ষিণখানের কাওলা এলাকার রেজাউল করিম হৃদয় ও আশুলিয়ার খেজুর বাগান এলাকার রিয়া আক্তারের বিয়ে হয়। হৃদয়ের কাওলার বাড়িতে বউভাত অনুষ্ঠান শেষে স্ত্রী রিয়া আক্তার, শাশুড়ি ফাহিমা আক্তার, খালা শাশুড়ি ঝর্ণা আক্তার ও তার ছোট ছোট দুই ছেলে-মেয়ে জান্নাতুল ও জাকারিয়াকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। প্রাইভেটকারটি (ঢাকা মেট্রো গ-২২-৬০০৮) চালাচ্ছিলেন হৃদয়ের বাবা আইয়ুব হোসেন রুবেল।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জসিম উদ্দিনের প্যারাডাইজ ভবনের সামনে বিআরটি প্রকল্পের উড়াল সেতু নির্মাণকাজে নিয়োজিত ক্রেন দিয়ে বক্স গার্ডার তোলা হচ্ছিল লোবেট ট্রাকে। কিন্তু বক্স গার্ডের তুলনায় ক্রেনের সক্ষমতা কম থাকায় ক্রেনটি কাত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বক্স গার্ডারটি এসে পড়ে প্রাইভেটকারটির ওপর। এতে প্রাইভেটকারের বাম পাশে থাকা নব দম্পতি হৃদয় ও রিয়াকে প্রত্যক্ষদর্শীদের সহযোগিতায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাকি পাঁচজনই প্রাইভেটকারের ভেতরে মারা যান।
মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহাসীন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই মামলায় নয়জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন মেয়াদে জেল খাটার পরে জামিনে বের হয়ে গেছে। এখন আমরা বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়ার অপেক্ষা করছি। ওই মতামত পেলেই আমরা মামলায় প্রতিবেদন দিয়ে দেব।’
দুর্ঘটনার পরে প্রথমে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। পরে সেটি বাড়িয়ে পাঁচ সদস্য করা হয়। গত ৪ সেপ্টেম্বর গঠিত কমিটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়। এরপর বুয়েটের এক্সপার্টকেও কমিটিতে যুক্ত করা হয়। তদন্ত করতে গিয়ে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গ্রেপ্তারসহ সবার বক্তব্য তারা নিয়েছেন। তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে। ভিডিও ফুটেজে তার বিবরণ আছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বলছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩৪টি চিঠি দিয়েছে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেটি মন্ত্রণালয়ে জানায়নি। তারা সেটি জানালে চাইনিজ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
এদিকে গার্ডার দুর্ঘটনার ১২ কারণ চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ ঘটনার ১২টি কারণ জানিয়েছে। চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বিকালে সচিবালয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী দুর্ঘটনার ১২টি কারণ জানান।
কারণগুলো হলো- পূর্বানুমতি ছাড়া ঠিকাদার কোম্পানি সরকারি ছুটির দিনে কাজ করেছে, বন্ধের দিন কাউকে না জানিয়ে কাজ করেছে, প্রথমবার দিনের বেলায় গার্ডার স্থাপনের কাজ করেছে, অন্যদিন তারা রাতে কাজটি করত। ক্রেনটি সহকারীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে, চালক থাকলে সেটি হতো না। ক্রেনটির লাইসেন্স ছিল না। ক্রেনটি যেখানে চালানো হচ্ছিলে সেই জায়গাটি অসমতল ছিল। ক্রেনটির ডিজিটাল মনিটর ছিল না। কাজের পূর্বানুমতি ছিল না। ট্রাফিক ব্যবস্থা ছিল না, মূলত ট্রাফিককে জানাতে হয়।
ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে যোগ্য লোক ছিল না, নিজেরা এসব লোক রেখেছিল। সেফটি ইঞ্জিনিয়ারের যথাযথ যোগ্যতা ছিল না। ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ছিল না। সেজন্য গার্ডার সরাতেও সময় লেগেছে। ঠিকাদার হিসেবে যাদের কাজ দেওয়া হয়েছিল তাদের কোনো অনুমোদন ছিল না।
এছাড়াও বিআরটিএ দুর্ঘটনায় নিহত আইয়ুব হোসেন রুবেলের প্রথম স্ত্রী শাহিদা খানম বাদী হয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিমের আদালতে একটি মামলা করেন। এরপর গত ১৭ আগস্ট রাতে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাট থেকে নয়জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইয়াসিন গাজী ঢাকাটাইমসকে বলেন, এ ঘটনায় আফরান বাবু নামের এক ব্যক্তি থানায় একটি মামলা করেছেন। আবার নিহত রুবেলের স্ত্রী শাহিদা খানম বাদী হয়ে আদালতে আরেকটি মামলা করেছেন। আমরা আদালতকে বলেছি, একই ঘটনায় দুইটি মামলা হওয়ার সুযোগ নেই। তাই দুইটি মামলাকে একটিতে এনে তদন্ত করা হবে। তবে নিহতদের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এখনও হাতে পাইনি। এছাড়াও বিআরটিএর প্রতিবেদনও হাতে পাইনি। এসব প্রতিবেদন পেলেই দ্রুত মামলায় চার্জশিট দিতে পারব। (ঢাকাটাইমস/১২নভেম্বর/এএ/কেএম)