দশ মাসে ৫৫৪০ জনের প্রাণ যায় সড়কে

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২২, ০৭:৪৭ | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২২, ১১:৪৮

মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকাটাইমস

প্রতিদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিলে মানুষের সারি বাড়ছেই। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে সারাদেশে শুধুমাত্র মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৩টি। এতে ২ হাজার ৯৭ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত  হয়েছেন ১ হাজার ২৮৬ জন। এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৬৫৫টি। নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৪০ জন। বিশ্লেষকরা বলছেন, অনিরাপদ সড়ক অবকাঠামো আর বিশৃঙ্খলা এর জন্য দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে পোলিও বা করোনার সময় যেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। সড়কে আবর্জনার স্তূপ, গাড়ি পার্কিং, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এসব বন্ধ করতে হবে।

গতকাল জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করা হয়েছে বিশ্বব্যাপী। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ওপর জোর দিয়েছে জাতিসংঘ।

এ উপলক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সড়ক দুর্ঘটনা, আহত-নিহতদের একটি সংখ্যা প্রকাশ করে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৬৫৫টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৪০ জন। একই সময়ে ২ হাজার ৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৭ জন নিহত হয়েছেন।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাদেশের সড়কে ৪ হাজার ৬৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারায় ৫ হাজার ২১১ জন। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাই হয়েছে ১ হাজার ১৮৯টি, যাতে প্রাণ হারান ৯৪৫ জন।
২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭৩৫টি। এতে মারা যান ৫ হাজার ৪৩১ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩৮১টি, যাতে নিহত হন ১ হাজার ৪৬৩ জন।

গত বছর মানে ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৭১টি। এতে প্রাণ হারান ৬ হাজার ২৮৪ জন। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৭৮টি, মৃত্যু বেড়ে হয় ২ হাজার ২১৪ জনে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১৬.৫৪ শতাংশ (৩৪৭ জন) ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী এবং ৭৩.১০ শতাংশ (১৫৩৩ জন) ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী। এছাড়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ৯২ জন পথচারী নিহত হয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর মধ্যে ৮৩৭টি দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলচালক এককভাবে দায়ী। বাসচালক দায়ী ১৬৯টি দুর্ঘটনায়, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরিচালক দায়ী ৭৪২টি দুর্ঘটনায়, প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাসচালক দায়ী ৫৬টি দুর্ঘটনায়, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান-নসিমন-ভটভটি-টমটম) চালক দায়ী ১১৯টি দুর্ঘটনায়, প্যাডেল রিকশা ও সাইকেলচালক দায়ী ১৭টি দুর্ঘটনায় এবং পথচারী দায়ী ৬৩টি দুর্ঘটনায়।’

‘দুর্ঘটনা কমানোর জন্য কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে। গণপরিবহন চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে। মোটরসাইকেল ও স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য মহাসড়কে সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।’ যোগ করেন সাইদুর রহমান।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দেশের সড়কে ধীর গতি এবং বেশি গতির যান একই সাথে একই রোডে চলে। এতে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। অনিরাপদ সড়ক অবকাঠামোও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এছাড়া রাস্তা দখল করে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তায় আবর্জনার স্তূপ, রাস্তায় গাড়ি পার্কিং, বেপরোয়া গতিতে চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলসহ বিভিন্ন কারণে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।’

তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে আমাদের সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে পারিনি।’

আমাদের সরকারের অনেক বড় বড় সাফল্য আছে উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘যদি ধরেন পোলিও, বিষয়টি নিয়ে সরকার পুরোদমে কাজ করেছে বলে এটি এখন নির্মূল হয়েছে। এরপর আসে করোনা মহামারি, এ ক্ষেত্রেও সরকারের বড় পদক্ষেপের কারণে এখন নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু দেখেন যে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে আমরা বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারিনি।’

এখনো সময় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দিরসহ সব জায়গায় যদি সামাজিক বৃহত্তর কর্মসূচি করতে পারি, সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে পারি, আমরা সবাই এগিয়ে এলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।’

‘এছাড়া আরেকটি বিষয় হলো, ‘দেশে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, এর সব খবর কিন্তু পাওয়া যায় না। প্রতিদিন দুর্ঘটনায় অনেক লোক আহত হয়। গ্রাম-গঞ্জের সড়কগুলোতেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। সঠিক খবর প্রকাশ পেলে আমাদের দুর্ঘটনার  কারণ যে কত গভীরে তা আরও অনুধাবন করা যেত।’
তিনি বলেন, ২০১৬ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা গেছে, ‘বাংলাদেশে প্রতিদিন দেড় শতাধিক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তার মধ্যে ৮০ জন মানুষ পঙ্গু হয়, আর ৬৪ জন মানুষ নিহত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিবেদনকে অস্বীকার করার মধ্যদিয়ে আসলে দুর্ঘটনার কারণ লুকায়িত করা হয়। এসব কারণে আমরা সমাধানের মূল জায়গায় পৌঁছাতে পারি না।’

যাত্রী কল্যাণ সমিতির এ মহাসচিব বলেন, ‘এছাড়া আপনি দেখবেন অনিরাপদ সড়ক অবকাঠামো আর বিশৃঙ্খলা চলছেই। রাস্তার অর্ধেক দখল করে আবর্জনার স্তূপ পড়ে আছে, রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করে রাখছে, বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে, ভালো রাস্তায় হঠাৎ করে গর্ত হয়ে আছে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। এসব বন্ধ করতে হবে।’

‘আমাদের আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। দেখবেন ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে শুধুমাত্র রোড ডিভাইডার দেওয়ার কারণে দুর্ঘটনা অনেক কমে গেছে। এছাড়া এখন আরও অনেক পদ্ধতি আছে। সেগুলো প্রয়োগ করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে’ যোগ করেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

(ঢাকাটাইমস/২১নভেম্বর/এমএইচ/এলএ)