সশস্ত্র বাহিনী জাতির আস্থার প্রতীক

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৪৭

মো. খসরু চৌধুরী সিআইপি

২১ নভেম্বর, সশস্ত্র বাহিনী দিবস। যথাযথ মর্যাদা ও উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতি বছর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ নভেম্বর একটি স্মরণীয় দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের এই দিনে তিনবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর সর্বাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করে। তাদের সম্মিলিত আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে, যা বাঙালি বিজয় অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-ভারতের সেনাদের নিয়ে গড়া মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রায় তিরানব্বই হাজার সেনা আনুষ্ঠানিকভাবে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। এ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ-এর পরিসমাপ্তি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান ও বীরত্বগাথা জাতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং আপামর জনগণ যে যেখানে পেরেছে সেখান থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উচ্চ মনোবল ও তীব্র দেশপ্রেমের শক্তিতে বলীয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার সীমান্ত সংলগ্ন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ডাকবাংলোয় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সভায় সেদিন থেকেই বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোকে 'মুক্তিবাহিনী' নামে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার কর্তৃক ১২ এপ্রিল তারিখে কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী পিএসসিকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের কমান্ডার-ইন-চীফ (কেবিনেট মিনিস্টার মর্যাদাসহ) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালের ১২-১৫ জুলাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশের সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে বাংলাদেশ ফোর্সেস সদর দপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোর অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীনে এই ১১টি সেক্টরের মাধ্যমে ৪ ডিসেম্বরে যৌথবাহিনী গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাপকভাবে সমগ্র বাংলাদেশে কার্যকরভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। এছাড়াও সভায় লে. কর্নেল (অব.) এম এ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের চীফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। কর্নেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সকল বিচ্ছিন্ন সংগঠনকে কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসেন এবং ফোর্সেস সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযযুদ্ধ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে অপারেশনাল নির্দেশনার প্রণয়ন করেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য এবং তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও নির্বাচিত সারারণ জনতার সমন্বয়ে গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনী বা 'মুক্তিবাহিনী'।

অপরদিকে সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, সেচ্ছাসেবী এবং আপামর জনসাধরণকে নিয়ে গেরিলা পদ্ধতির আদলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় 'গণবাহিনী'। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সকল বাহিনীকেই তাঁদের সদস্যদের ও প্রচলিত অর্থে মুক্তিবাহিনী এবং ক্ষেত্র বিশেষে 'মুক্তিফৌজ' নামে অভিহিত করা হতো। ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, গণবাহিনী এবং নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ একযোগে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করে যে কারণে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর দিনটি সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালিত হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীনে গঠিত বিভিন্ন ব্রিগেড এবং সেক্টরের নিয়মিত, অনিয়মিত সৈন্য এবং আঞ্চলিক গেরিলাদের সমন্বিত যুদ্ধ এবং ৪ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঠিত যৌথকমান্ডের চূড়ান্ত অভিযানের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাত সদস্যকে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়া হয়, ৫৮ জনকে বীর উত্তম, ১৩৪ জনকে বীর বিক্রম এবং ১৭৮ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয়।

সশস্ত্র বাহিনী আজ জাতির আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী দুর্যোগ মোকাবিলা, অবকাঠামো নির্মাণ, আর্তমানবতার সেবা, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা এবং বিভিন্ন জাতিগঠনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে।

জাতীয় উন্নয়নে সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অবদান আজ সর্বজন স্বীকৃত। সশস্ত্র বাহিনী এমনি এক বাহিনী যার প্রতি এদেশের জনগণের রয়েছে অগাধ আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কল্যানে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের  উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা ছাড়াও দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ছিন্নমূল মানুষের জন্য বাসস্থান তৈরি করা এবং অন্যান্য জনকল্যাণমুখী কাজে প্রতিনিয়ত সশস্ত্র বাহিনী নিবেদিতপ্রাণ। ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয় পত্র, মেশিন রিডএ্যাবল পাসপোর্ট সহ জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণ, ফ্লাই ওভার, আন্ডারপাস নির্মানে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের ভুমিকা অত্যন্ত গৌরবজনক।

লেখক: রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ; চেয়ারম্যান, নিপা গ্রুপ ও কেসি ফাউন্ডেশন