জঙ্গি তৎপরতা: সেই মেজর জিয়া কোথায়?

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২২, ২২:২৯ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২২, ০৮:২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হকের নাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য, সৈয়দ জিয়াউল হকের অবস্থান সম্পর্ক কোনো তথ্য নেই। তিনি ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি।

 

ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াকে গ্রেপ্তার করতে প্রায় নয় বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে কয়েকবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার সন্ধান পেয়েছে দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

 

মেজর জিয়া এখন কোথায় জানতে চাইতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদজ্জামান খাঁন কামাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, জঙ্গি মেজর জিয়া এখন কোথায় আছে সেটা আমাদের জানা নেই।

 

তবে আদালত পাড়া থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় শেষ অবস্থা জানাতে সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মলনের আয়োজন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিএমপি ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেছেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা আমাদের নজরদারীতেই রয়েছে। তাদেরকে অচিরেই গ্রেপ্তার করা হবে।

 

সৈয়দ জিয়াউল হক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের মূল নেতা বলেও তথ্য প্রমাণ থাকার কথা পুলিশ বলে আসছে। এই জঙ্গি সংগঠনটির আল কায়দার সঙ্গে যোগসূত্র আছে বলে বলা হয়ে থাকে।

 

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে গ্রেপ্তারের পর জিয়াউল হকের উগ্রপন্থায় সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারে গোয়েন্দারা। তারা বলছেন, ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা লেখকসহ অন্তত নয়জনকে টার্গেট করে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন এই চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা। আরও কয়েকজনকে হত্যাচেষ্টা পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, মেজর জিয়ার তত্ত্বাবধানে এবিটির অন্তত আটটি স্লিপার সেল তৈরি হয়। প্রতিটি সেলের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। সেই হিসাবে অন্তত ৩০ জন দুধর্ষ ‘স্লিপার কিলার’ জঙ্গি তৈরি করেছেন তিনি। তারাই ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করেছে।

 

২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম এই মেজর জিয়া। সে সময় বেশ কয়েকজন ধরা পড়লেও পালিয়ে যান তিনি। তিনি পলাতক থেকেই দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছেন।

রাজধানী ও এর আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পরও জিয়ার নাম জানা যায়। এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পায় আইনশঙ্খলা বাহিনী।

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) একাংশের সঙ্গেও মেজর জিয়ার যোগাযোগের প্রমাণ পায় গোয়েন্দারা। তাকে ধরতে ২০ লাখ টাকা পুরষ্কারও ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন আইজিপি শহীদুল হক। কিন্তু তাকে ধরতে সক্ষম হয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মেজর জিয়ার তথ্য পাওয়ার জন্য ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মেজর জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে দুই ধরনের তথ্য পাওয়ায় জিয়া আসলে কোথায় আছেন সে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

 

কোনো অপরাধীকে চিহ্নিত করতে বা তার অবস্থান জানতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করে পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া পরিচিত হওয়ায় তার অবস্থান সম্পর্কে জানা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

 

অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেনকে পলাতক দেখিয়ে নিম্ন আদালতে ইতিমধ্যে বিচার হয়েছে। তাতে এই দুজনসহ পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।

 

কে এই মেজর জিয়া?

জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। আত্মগোপনে যাওয়ার আগে মিরপুর সেনানিবাসে থাকতেন।

 

২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীর সাবেক ও তৎকালীন কিছু সদস্য দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে মেজর জিয়া অন্যতম।

 

নয়টি হত্যারমূল পরিকল্পনায়’ জিয়া

২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন এমন দুজনকে হত্যা করেছে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি। এই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হত্যার পেছনেও ছিল তারা। এসব ঘটনার তদন্ত করে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জিয়ার নাম উঠে এসেছে।

 

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুজনকে হত্যা করে এবিটির স্লিপার সেলের সদস্যরা। তারা দুজনই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। একই বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

 

২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

 

ওই বছরের শেষ দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।

(ঢাকাটাইমস/২১নভেম্বর/এএ/কেএম)