শীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় কমলালেবু

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০২২, ০৯:০৯ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২২, ০৯:১২

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

শীতের শুরুতে চারিদিকে বাতাসে হালকা হিমেল হাওয়া। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে আগমন ঘটে কমলালেবুর। উজ্জ্বল কমলা রঙের এই ফলটি ছাড়া শীত যেন ভাবাই যায় না। বাড়িতে বসে ব্রেকফাস্টে বা পিকনিকে গিয়ে দুপুরের রোদে বসে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কমলালেবু খাওয়ার ব্যাপারই আলাদা। তবে শুধু উপভোগের ব্যাপারই নয়। কমলালেবু রীতিমতো উপকারী এক ফল।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলেন, কমলার কোয়া ও খোসা দুটোই পুষ্টিতে ভরপুর। কেবল স্বাদই নয়, স্বাস্থ্যের কারণেও এই মৌসুমী ফলকে ডায়েটে রাখতে বলেন বিশেষজ্ঞরা। শীতে স্ট্রোক রুখতে, ওবেসিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও শরীরে ফাইবারের চাহিদা মেটাতে খুবই কাজে আসে।

কমলা খেলে ক্ষুধা বাড়ে, রুচি বাড়াতেও সাহায্য করে। শরীরে কোলেস্টেরল কমাতেও কমলালেবুর জুড়ি মেলা ভার। লিভার কিংবা হার্টের বিভিন্ন রোগে কমলালেবু খাওয়া উপকারী। হাইপারটেনশনের রোগীদের ক্ষেত্রেও কমলা খেলে উপকার অনেক।

প্রতি ১০০ গ্রাম কমলাতে আছে ভিটামিন বি ০.৮ মিলিগ্রাম, সি ৪৯ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৩ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম ৩০০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২৩ মিলিগ্রাম। প্রতিদিন কমলা খেতে অনেকে পছন্দ করেন না। সেক্ষেত্রে কমলার জুস বানিয়ে খেতে পারেন। এতে স্বাদটাও বাড়বে আবার পুষ্টিগুণও কমবে না।

কমলালেবু সাইট্রাস জাতীয় গাছের রসালো ফল। কমলা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস রেটিকুলাটা । চীনে কমলার চাষ শুরু হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। এরপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব ভারতে কমলা চাষ শুরু হয় । খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমানরা ভারত থেকে কমলা নিয়ে চাষ শুরু করে। অন্যদিকে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯৩ সালে হাইতিতে কমলা রোপন করেন। এরপর ১৫১৮ সালের দিকে ব্রাজিলের পরপরই পানামা ও মেক্সিকোতে কমলা চাষ শুরু হয়। অন্যদিকে স্প্যানিশ অনুসন্ধানকারী হুয়ান পঞ্চ ডি লিওন আমেরিকায় প্রথমবারের মতো কমলা চাষের সুচনা করেন ১৫১৩ সালে। ভ্যালেন্সিয়া, ব্লাডি অরেঞ্জ, ন্যাভেল আর পার্সিয়ান জাতের কমলা সবচেয়ে মিষ্টি হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, কমলার রস খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই সঙ্গে হৃৎপিন্ডও ভাল থাকে।

শরীরে থাকা সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের মাত্রা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। সোডিয়াম রক্তচাপ বাড়ায় আর পটাশিয়াম এটি কমিয়ে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। বিশেষজ্ঞরা এ কারণে রক্তচাপ কমাতে খাদ্য তালিকায় নিয়মিত পটাশিয়াম যোগ করতে বলেছেন। কমলার রসে দিনের প্রয়োজনীয় ৮ ভাগ খনিজ পাওয়া যায়।

আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত একটা জার্নাল থেকে জানা যায়, যারা অল্প বয়সে বেশি পরিমাণে ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খান ২০ বছরের পর তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কম থাকে। কমলার রসে দৈনিক চাহিদার ২০ ভাগ ফলিক এসিড থাকে।

বিটামিন সি’এর দারুন উৎস হচ্ছে কমলার রস। একটা কমলা দিনের চাহিদার শতভাগ ভিটামিন সি নিশ্চিত করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন সি রক্তচাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কমলার মতো সাইট্রাস জাতীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।

আমেরিকান ও কানাডিয়ান গবেষকদের বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে লেবু জাতীয় ফলের খোসায় পলিমেথোক্সিলেটেড ফ্ল্যাভোনিস নামক উপাদান থাকে যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধে নানারকম সাইড এফেক্ট থাকতে পারে কিন্তু লেবুজাতীয় ফলের খোসায় সেই ভয় নাই।

কমলা লেবুতে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যআঁশ থাকে যা রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই ডায়াবেটিস আক্রান্তদের জন্য কমলা অত্যন্ত উপকারি। তার উপর কমলা লেবুতে সাধারণ রাসায়নিক গঠনের চিনি থাকে ও ফ্রুকটোজ থাকে। এতে করে কমলা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে চিনির মাত্রা অত্যধিক বাড়িয়ে দেয় না। গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্সে ৫০ এর নীচে থাকা খাবারে চিনির পরিমাণ কম থাকে।

কমলালেবুতে ডি-লিমোনিন থাকে যা ফুসফুসের ক্যানসার, ত্বকের ক্যানসার এমনকি স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। কমলায় থাকা ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড়িয়ে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। সাধারণত দেখা যায় ডিএনএ-তে পরিবর্তনের (মিউটেশন) কারণে ক্যানসার ধরা পড়ে যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে ভিটামিন সি। তাছাড়া কমলায় থাকা খাদ্যআঁশও ক্যানসারের হাত থেকে রক্ষা করে।

কমলালেবুতে এসিডের পরিমাণ বেশি হলেও এটাতে প্রচুর পরিমাণ অ্যালকালাইন খনিজ আছে যা খাবার হজমে সাহায্য করে। কমলালেবু অনেকটাই লেবুর মতো অ্যালকালাইনযুক্ত খাবার।

কমলায় প্রচুর পরিমাণ ক্যারোটেনয়েড ও ভিটামিন এ থাকে। এগুলো চোখের মিউকাস মেমব্রেন সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পেশীতে ক্ষয়জনিত সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে যার ফলে অনেকসময় অন্ধত্ব দেখা দেয়। এই ক্ষয় প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে ভিটামিন এ। ভিটামিন এ আলো শুষে নিতেও সাহায্য করে।

কমলার রসে উপস্থিত বিটা ক্যারোটিন সেল ড্যামেজ প্রতিরোধে সহায়তা করে।

কমলালেবু স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ কমিয়ে মুড বুস্টিং হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায়। স্মৃতি শক্তি বাড়াতে কমলালেবু বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

কমলালেবুর রসে থাকা ভিটামিন বি-৬ দেহে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়ক। কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক কমলালেবু।

ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষা করে কমলালেবু। ঝকঝকে ত্বকের জন্য ভিটামিন-সি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ কমলালেবু অনবদ্য। ব্রন, সানবার্ন, ত্বকের শুষ্কতা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা থেকে ত্বককে রক্ষা করে কমলালেবু।

কমলা খাওয়ার পর, অনেকেই খোসা ফেলে দেন। কমলার খোসাতেও গুণের শেষ নেই। কমলার খোসা নানাভাবে রূপচর্চায় অত্যন্ত উপযোগী। স্কিনে ব্ল্যাকহেডস দূর করতে সহায়ক। একেবারে প্রাকৃতিক উপায়ে দাঁতের হলদে ভাব দূর করতে পারে কমলার খোসা। কমলালেবুর তাজা খোসা বেঁটে টুথপেস্টের মতোও ব্যবহার করা যায়। নানা গুণের ভান্ডার এই ফলটি সুস্বাদু, সুলভ কিন্তু পুষ্টিগুণে অনন্য।

কফ ও পিত্তের সমস্যায় : কমলার খোসার রসের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো এটি কফের সমস্যা ও পিত্তের যে কোনো ধরনের সমস্যা দূর করে। এজন্য কমলার খোসা কুচি করে রঙ চা তৈরি করে খেতে হবে।

পেটের সমস্যায় : কমলালেবুর খোসা পেটের সমস্যার সমাধান করে। এমনকি গ্যাস, অ্যাসিটিডি ও বমি বমি ভাব দূর করতেও কমলার খোসার জুড়ি নেই। এর জন্য প্রতিদিন সকালে খোসার মিহি কুচি এক চা চামচ পরিমাণ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারেন।

ওজন হ্রাসে : উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরলের সমস্যা এবং ওজন কমানোর জন্য কমলার খোসা অনেক বেশি কার্যকরী। কারণ এতে ট্রাইগ্লিসারাইড দ্রবীভূত থাকে যা সমস্যাগুলো দূর করতে সাহায্য করে।

অনিদ্রায় : কমলার খোসা মিশ্রিত পানি গোসলের সময় ব্যবহার করলে এটি অনিদ্রা দূর করে। এমনকি কুসুম গরম পানিতে এর খোসা ফেলেও গোসল করা যায়। তবে চাইলে পানির সঙ্গে খোসার তেল মিশিয়ে নিতে পারেন।

ক্যানসার ও হাড়ের রোগ প্রতিরোধে : কমলার খোসায় ফ্লেভোনয়েড রয়েছে যা ‘হেস্পিরিডিন’ নামে পরিচিত। এটি কোলন ক্যানসার এবং অস্টিওপরোসিস বিরুদ্ধে কাজ করে আমাদের রক্ষা করে।

অ্যাসিডিটির সমস্যায় : কমলার খোসার তেলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি রয়েছে যা পেটের অ্যাসিডিটি দূরীকরণে সহায়তা করে। এছাড়াও এতে ডি-লিমোনেন নামের একটি উপাদান আছে যা অন্ত্র ও লিভার ফাংশনকে স্বাভাবিক রাখে। আর এর তেল পানিতে দুই ফোঁটা মিশিয়ে পান করলে অ্যাসিডির সমস্যা একেবারেই চলে যাবে।

অ্যাজমা ও কাশির সমস্যায় : কমলার খোসার গুঁড়া কাশির সমস্যা দূর করে। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ও অ্যাজমা উপশমে এটি কাজে লাগে। এসব কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে কমলার খোসায় তৈরি চা নিয়মিত পান করুন। আবার কমলার খোসা দিয়ে মোরব্বা বা টফিও তৈরি করে রাখা যায়। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে এই টফি চা পানের সময় ভালো করে চিবিয়ে খেতে পারেন। এতে রোগমুক্তি ঘটবে।

 

কমলালেবুর খোসার চা যেভাবে বানাবেন

ভিটামিন সি-তে সমৃদ্ধ কমলালেবুর খোসা চা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো বাড়িয়ে দেয়। শীতের সকালে ঘুম কাটতে না চাইলে এই চা মুখে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকালটা সতেজতায় ভরিয়ে তুলবে। রোদে বা শুকনো খোলায় কমলালেবুর খোসা একটু নাড়াচাড়া করে নিন। রস একেবারে শুকিয়ে গেলে মিক্সিতে গুঁড়ো করে রেখে দিন। সকালবেলা উঠে গরম পানিতে আধ চা চামচ এই খোসার গুঁড়া নিয়ে তা গুলে নিলেই হল। অবশ্য এই চায়ের সঙ্গে যদি একটু আদা মিশিয়ে নিতে পারেন, স্বাদ বাড়বে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এই চা খেলে সাধারণ সর্দি-কাশি হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। এ ছাড়া, হজমের সমস্যা বা অ্যাসিডিটি হলে এই চা খেতে পারেন। অনেক উপকার হয়। যাদের সকালে ডিটক্স ওয়াটার খাওয়ার অভ্যাস আছে, তারা এই চা খেলে আলাদা করে আর কিছু খাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে ধরনের সংক্রমণ হয়, তা ঠেকাতে, ওজন ঝরাতেও খেয়ে দেখতে পারেন কমলালেবুর খোসা দিয়ে বানানো চা।

(ঢাকাটাইমস/২৩ নভেম্বর/আরজেড)