ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ‘হিডেন এজেন্ডা’ নিয়ে ব্যস্ত

প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:১৮ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২২, ১২:৫৪

মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকাটাইমস

বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না বললেও দিন দিন এটা বেড়েই চলেছে। সাধারণ লোকজন ঋণের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঋণ পাচ্ছেন না। আর অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনেকেই ঋণ নিয়ে সেটি আর পরিশোধ করেন না।

এদিকে ঋণের বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জামানত হিসেবে যে চেক নিচ্ছে সেটি বেআইনি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, গরিবরা ঋণ নিলে সেটি মওকুফ করা হয় না।  ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ, অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে, তাদের হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়নে চেকের অপব্যবহার করে মামলা করে থাকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ দেওয়ার আগে ভালো করে যাচাই বাছাই করে নেওয়া উচিত। ঋণ ঠিকই দেওয়া হচ্ছে কিন্তু যারা ঋণ পেয়ে দেশের উৎপাদনে কাজ করবে তারা পায় না। যাদের আগেও ঋণ খেলাপি আছে নতুন করে তাদেরই দেওয়া হয়। এছাড়া যাদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে তাদের ওপর মনিটরিং বাড়াতে হবে। এসব অনিয়মের সঙ্গে কিছু ব্যাংকের লোকেরও যোগসাজশ থাকে।

বুধবার চেক ডিজঅনার মামলার বিষয়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছেন। হাইকোর্ট বলেছেন, এখন থেকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে না। হাইকোর্ট রায়ে আরও বলেছেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের জন্য শুধুমাত্র ২০০৩ সালের অর্থঋণ আইনের বর্ণিত উপায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে পারবে। চলমান ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা সব চেক ডিজঅনার মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলেও রায়ে বলা হয়েছে।

ঋণ আদায়ের জন্য এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্র্যাক ব্যাংকের চেক ডিজঅনার মামলা বাতিল করে এ রায় দেন।

আদালত বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ একটি চুক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়ে থাকে। ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ, অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে, তাদের হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়নে চেকের অপব্যবহার করে মামলা করে থাকে। তাদের ব্যবহার দাদন ব্যবসায়ীদের মতো। ঋণের বিপরীতে ব্ল্যাংক চেক নেওয়াটাই বেআইনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি কাজ করে আসছে।

হাইকোর্ট বলেন, ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল গরিবের বন্ধু। কিন্তু তা না, ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গরিবের রক্ত চুষছে। যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছে ব্যাংক তাদের ঋণ মওকুফ করার কথা শুনি। কিন্তু কোনো গরিবের ঋণ মওফুফ করার কথা কোনোদিন শুনিনি। নীলকর চাষিদের মতো, দাদন ব্যবসায়ীদের মতো যেনতেন ঋণ আদায় করাই তাদের লক্ষ্য।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি হাইকোর্টের রায়ের আলোকে নির্দেশনা জারি করতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘লোন দেওয়ার আগে ভালো করে যাচাই বাছাই করে নিতে হবে। কাগজের দিকে না তাকিয়ে ওই ব্যবসায়ীর পূর্বের অবস্থা বা ব্যবসার অবস্থা জেনে ঋণ দিতে হবে। এরপর তার বিজনেসের আউটপুটটা কী বা কেন সে ঋণ নিচ্ছে সেটি জানতে হবে। এরপর তাকে ঋণ দেওয়া উচিত। এরপর তার ওপর ফলোআপ রাখতে হবে, মনিটরিং করতে হবে।’

ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশও থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হলো ক্ষুদ্র বা মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ চেয়ে পায় না। ব্যাংকগুলোও ইনডাইরেক্টলি অনীহা প্রকাশ করে। তাদেরকে বিভিন্ন কাগজ আনেন, এটা আনেন, ওটা আনেন করে হয়রানি করে। কিন্তু বড় রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে দেখবেন এটা করে না। নতুবা যারা ইতিমধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বা খেলাপি তারাই পায়। কিন্তু যারা লুটপাট করছে, বিদেশে পাচার করছে এসব দেখেও ব্যাংকগুলো তাদেরই ঋণ দিচ্ছে।’

এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও গাফিলতি আছে উল্লেখ করে সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব এবং আইএমএফের পর্যবেক্ষণ মিলে না। তারা তথ্য লুকিয়ে রাখে। কী পদক্ষেপ নেয় সেটাও বলে না। পলিসি মেকার বা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দিব, দিচ্ছি, আশা করছি এমন বক্তব্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সোজাসুজি বলবে, এটা হয়েছে বা এটা করেছি।’
 
সিদ্ধান্ত নিতে কোনো চাপ আছে কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তেমন একটা চাপ থাকার কথা নয়। তবে পলিটিক্যালি একটা বিষয় থাকতে পারে। দেখা গেল যে সরাসরি কেউ কিছু না বললেও যারা ব্যবসায়ী তারা অনেকেই পলিটিক্যালি একটিভ। বিভিন্ন সংগঠন আবার সরাসরি এটা করবেন, এটা করবেন না বলে। কিন্তু এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যেটা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ভালো সেটি করতে হবে।’

‘গ্রোথ একটি সংখ্যা মাত্র, এ অবস্থার কারণে গ্রোথের সুফলটা সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না, ভালো ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে না। আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’-যোগ করেন সালেহ উদ্দিন।

(ঢাকাটাইমস/২৪নভেম্বর)