বিস্ময়কর ঐতিহাসিক সুরা মসজিদ

প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১০:০৮ | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১০:২৮

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর

ঐতিহাসিক সুরা মসজিদ। এর ইতিহাস সত্যিই বিস্ময়কর। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার সুরা নামক স্থানে অবস্থিত এ মসজিদের। এ মসজিদ ঘিরে রয়েছে নানা রূপকথা। মসজিদটি জনহীন এক জনপদের নীরব সাক্ষী। এর নাম নিয়েও আছে নানা কাহিনী।

কেউ বলেন, সৌর মসজিদ, কেউ সুরা মসজিদ। আবার কেউ বলেন, শাহ সুজা মসজিদ। সুর শব্দের অর্থ অপদেবতা বা জিন।

স্থানীয়রা জানান, ওই সময়কালে এক রাতের মধ্যে জিনেরা এটি নির্মাণ করে দেয়। তাই এর নাম হয় সুরা মসজিদ।

কেউ বলেন, ওই জায়গার নাম সুরা বলে একে সুরা মসজিদ বলা হয়। আর সৌর শব্দের অর্থ আসমানি বা গায়েবি।

জনশ্রুতি আছে, গায়েবিভাবেই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। আবার অনেকের মতে, মোগল আমলে বাংলার নবাব সুজা এটি নির্মাণ করেছেন বলে এর নাম রাখা হয় শাহ সুজা মসজিদ।

কিন্তু, শাহ সুজা ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগে এ মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এ মসজিদের গঠনকৌশল দেখে ধারণা করা হয়, এটা হোসেন শাহর আমলের।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দানি এটিকে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত বলে অনুমান করেন। তাই মসজিদটি সুলতানি আমলে (১৪৯৩-১৫১৮) খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। মুসলিম আমলে গৌড় থেকে ঘোড়াঘাট যাওয়ার পথ ছিল একই। এ সময় মুসলমানদের নামাজ পড়ার সুবিধার জন্য খুব সম্ভব এখানে এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল। ঘোড়াঘাটে মুসলিম আমলের পাকা ঘাটওয়ালা বিশাল দিঘির পাশেই এই সুরম্য মসজিদ।

দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট ইউনিনের চৌগাছা মৌজায় হিলি রোড়ে অবস্থান প্রাচীন এই মসজিদটি। ঘোড়াঘাট উপজেলা কেন্দ্র থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে পাকা রাস্তার উত্তর ধারে বিশাল পাড়ওয়ালা দিঘির ধারে এই মসজিদটি।

নির্মাণ ও গঠনশৈলী দেখে ধারণা করা যায়, সম্রাট শাহ সুজার ক্ষমতা গহণের অনেক আগে এটি নির্মিত হয়েছে। আর যেহেতু এই মসজিদটি কোন শিলালিপি নেই তাই গঠনশৈলীর উপর ভিত্তি করেই সম্ভাব্য নির্মাণকাল বের করা হয়। স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ কলাকৌশল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা যায় বাংলা নবাব হোসেন শাহী আমলের নিদর্শন এটি। তাছাড়া ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দানী একে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে নির্মিত বলে অনুমান করেন। আবার কারো কারো মতে, এটি সুলতানি আমলে ১৪৯৩ থেকে ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত।

মসজিদটি ইট ও পাথরে নির্মিত। এর চারপাশে ছড়িয়ে আছে কিছুসংখ্যক প্রস্তরফলক। কিছু কিছু প্রস্তরফলকে ছোট সোনা মসজিদে ব্যবহৃত নমুনার প্যানেল ও অন্যান্য ডিজাইন রয়েছে।

এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকার এই মসজিদের সম্মুখভাগে একটি বারান্দা আছে। মসজিদটি একটি উঁচু চত্বরের ওপর নির্মিত। পূর্ব পাশ থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি চত্বর পর্যন্ত উঠে গেছে। উন্মুক্ত চত্বরটির চারপাশ পুরু প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। বর্তমানে স্থাপনাটির ভিত পর্যন্তই প্রাচীর রয়েছে। তবে পূর্ব পাশের প্রবেশদ্বারের উচ্চতা থেকে অনুমান করা যায়, মসজিদটি বাইরের শব্দ ও কোলাহল থেকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে বেষ্টন-প্রাচীরগুলোও যথেষ্ট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংলার আর কোনো মসজিদে এমন কৌশল আগে কখনো দেখা যায়নি।

মসজিদটিতে একটি বর্গাকার নামাজকক্ষ আছে, যার সব দিকের দৈর্ঘ্য ৪.৯ মিটার। সব কোণে আছে অষ্টভুজ স্তম্ব, মোট স্তম্ভ সংখ্যা ছয়। কার্নিস রীতিমাফিক বাঁকানো। পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দিকে আছে তিনটি কারুকার্যখচিত মিহরাব। হলঘরটি একটি গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজটি স্তম্ভের ওপর বসানো স্কুইঞ্চের ওপর স্থাপিত। মসজিদের বারান্দাজুড়ে আছে তিনটি গম্বুজ। এই গম্বুজগুলো পেন্ডেন্টিভ পদ্ধতিতে স্থাপিত। ছোট সোনা মসজিদের সঙ্গে এই গম্বুজগুলোর ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে।

দালানটির বহির্গাত্রে গোলাপ ও অন্যান্য লতাপাতার নকশাখচিত পোড়ামাটির কারুকাজ আছে। জ্যামিতিক আকৃতির কিছু নকশাও দেখতে পাওয়া যায়। ভেতরের মিহরাবগুলো ছিল সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি। মধ্যবর্তী মিহরাবটি সূক্ষ্মভাবে কারুকার্যখচিত। শিকল ও ঘণ্টার মোটিফ, লতাপাতার নকশা, লেখ্য পটের মোটিফ এবং জ্যামিতিক আকৃতির নকশাগুলো করা হয়েছে বেশ চমৎকারভাবে। গম্বুজগুলোর ভিত পোড়া মাটির কারুকার্যখচিত ইট দ্বারা অলংকৃত।

তবে এ মসজিদের কোনো লিপিফলক পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি এ স্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে চম্পাতলী নামক স্থানে আলাউদ্দীন হোসেন শাহর আমলের একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। তাতে ৯১০ হিজরি/১৫০৪ খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ আছে। এতে একটি মসজিদ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। যদি ধরে নেওয়া হয়, এই লিপিটির সঙ্গে সুরা মসজিদের সম্পর্ক আছে, তাহলে মসজিদটির নির্মাণকাল ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দ বলে ধারণা করা যায়।

মসজিদে নকশাগুলোই একে মানুষের কাছে আরো দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। মসজিদের পাশে একটি পুকুর রয়েছে, যেখানে মুসল্লিরা অজু করে থাকেন। আর এই পুকুরের চারপাশে রয়েছে কবরস্থান। অন্যদিকে শুক্রবারে মুসল্লিদের জন্য এখানে সিন্নি বা তবারকের ব্যবস্থা করা হয়।

৫৫০ বছর আগে নির্মিত দিনাজপুরের টেরাকোটা অলংকরণ ও পোড়া মাটির চিত্রফলকের সুরা মসজিদ এখন অস্তিত্ব-সংকটে।

সুরা মসজিদের মোতাওয়াল্লি সেকেন্দার আলী জানান, প্রাচীন এ সুরা মসজিদ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ছুঁটে আসে। এ মসজিদে এখনো নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা আছে। মসজিদটি সংস্কার এবং এর নির্মাণশৈলী পুনঃনির্মাণ করা হলে ব্যাপক হারে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটবে। এমনটাই দাবি পর্যটক ও এলাকাবাসীর।

(ঢাকাটাইমস/২৫নভেম্বর/এলএ/এসএ)