মায়ের চেয়ে বড় কোনো কিছুই নেই
প্রকাশ | ২৭ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৪১ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২২, ১১:০৬
আলম ভাই আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। চট্টগ্রামে চাকুরির সুবাদে আলম ভাইয়ের পরিবারের সাথে একটা আত্মিক বন্ধন হয়ে গেছে আমার। সকলের সাথেই নিবিড় যোগাযোগ, যেন একই পরিবারের আমরা। আলম ভাইয়ের কর্মস্থল ইউএসএ এর লস এঞ্জেলস। আলম ভাইয়ের সাথে সেদিন ফোনে আমার এক ঘন্টার মত কথা হয়। কথা বলার সময় মুহুর্মুহু অশ্রুসিক্ত হয়েছি, আবেগে আমি কেঁদেছিও। আজ আমার লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় আলম ভাইয়ের সাথে ফোনের সেই আবেগী কনভারসেশন যা মনে হলে প্রতিনিয়ত গা শিউরে উঠে আমার।
স্থানীয় সময় রাত আড়াইটা। স্বভাবতই আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন। বাংলাদেশের ফোনের রিংগিং এ হঠাৎ ধরফর করে জেগে উঠি। ভয় পেয়ে গেলাম কোন খারাপ খবর নয়তো! দেখি বড় ভাইয়ের ফোন। তিনি জানান মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, শরীরটা খুব বেশি ভালো নয়।
দ্বিতীয় লাইন বলার আগেই আমি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে যাব এবং আজ এক্ষুনি।
সকালে উঠেই সব কাজ ফেলে দ্রুত কভিডের জন্য স্যাম্পল দিয়ে টিকিটের খোঁজ নিতেই সে রাতেই ফ্লাইট পেয়ে গেলাম। মিসেসকে শুধু জানালাম টিকিট পেয়ে গেছি, মার অবস্থা খুব খারাপ, আমি আজই বাংলাদেশে যাচ্ছি। ১১০০ ডলারের টিকিট আমাকে যদিও কাটতে হল ১৯৮০ ডলার দিয়ে তারপরও নিজেকে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল।ইমারজেন্সি টিকেট পাওয়ায় মহান আল্লাহ তালাকে শুধু ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম।
আমরা তিন ভাই ছয় বোন, মার বয়স ৮০ র উপরে। আমাদের পৈত্রিক বাড়ী চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। শহরের খুলশিতে ভাই-বোনরা সবাই থাকে। মাকে পুরোপুরি সুস্থ জানি। আমার সাথে প্রতিদিন ফোনে কথা হয় ।নিয়মিত কোরআন শরীফ পড়ে, নামায পরে, হাঁটাচলা করে, তসবিহ তাহলীল করে।। বড় ভাইয়ের ফোনে কেমন জানি ভয় পাচ্ছিলাম। মা বেশী অসুস্থ এটা মেনে নিতে পারছিলামনা।
বিমানের পুরো জার্নি টেনশন অস্হিরতায় কাটলেও ঢাকায় সময় মতো ল্যান্ড করলাম। আমার এক বড় ভাই ডোমেস্টিক এয়ার চট্টগ্রামের টিকেট কেটে অপেক্ষা করতেছিলেন ঢাকা এয়ারপোর্টে। লম্বা জার্নি করেছি বলে তিনি ঢাকায় রেস্ট নিয়ে পরের দিন চিটাগাং যেতে অনুরোধ করলেন। ঢাকায় আমি এক মুহূর্তও দেরি করতে চাইনি। আমি মার কাছে যেতে চাইলাম। এয়ারপোর্টে নেমে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই চিটাগাং পৌঁছে গেলাম। আম্মা নগরীর পার্ক ভিউ হসপিটালে ভর্তি ছিল। আমি খুলশীর বাসায় না গিয়ে সরাসরি হসপিটালে গেলাম।
আমি গিয়েই মা কে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমাকে দেখে অনেক কান্নাকাটি করল। হসপিটালের একটা কেবিনে আম্মাকে রাখা হয়েছিল। পাশে একটা ছোট বেড। আমি আর বাসায় না গিয়ে সেদিন সেই কেবিনেই রয়ে গেলাম। আম্মা একা হাঁটতে পারেন না। গোসলও করতে পারেন না। তবে প্রতিদিন গোসল করতেই হবে তাঁকে। খাবার খেতে গেলে হাত কাঁপে, তাই বেশির ভাগ সময় আমিই মাকে খাইয়ে দেই। মায়ের হাতে-পায়ে ব্যথা হয়, অন্য ভাইবোনদের সুযোগ না দিয়ে আমিই হাত-পা টিপে দিই। আম্মা দশ দিন হসপিটালে আমার সাথে ছিল। আমি সেই ছোট্ট বেডে পরে থাকতাম। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আম্মার অক্সিজেনের স্যাচুরেশন কমে যেত। আমরা সব ভাই বোন বসে থাকতাম। আমি এই দশ দিনের মধ্যে শুধুমাত্র একদিন এক বেলার জন্য বাসায় গিয়েছিলাম কিছু কাপড় চেঞ্জ করার জন্য। হসপিটালের রুমে খেতাম, মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে, আবার অনেকে খাবার নিয়ে আসতো, আম্মার পাশে বসেই তা খেতাম।
আম্মা কিন্তু বেশ স্টেবল। হসপিটালে দেখছিলাম বেশ ভাল হয়ে উঠছিল। কিন্তু এক বিকালে হঠাৎ আম্মার কাঁপুনি দিয়ে খিচুনি উঠলো। ডিউটি ডাক্তারকে ডাকা হল,বিশেষজ্ঞ আসলেন। বড় ধরনের স্ট্রোক করছে আম্মা, তার একপাশটা অবশ হয়ে যাচ্ছে বুঝতেছিলাম। একদম আমার হাতের সামনে এই ঘটনা ঘটলো। চাচ্ছিলাম আম্মা অন্তত বেঁচে থাকুক, মাকে তো আমি অন্তত জোরে মা বলে ডাকতে পারবো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা। তার একদিন পরেই মা আল্লাহ তায়ালা র ডাকে চলে গেলেন।
রেজা ভাই, আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, যে ১০ দিন হসপিটালে ছিলাম, আমার ভাইবোনদের আমি কিছুই করতে দিতামনা, আমি নিজেই করে ফেলতাম। এমনকি মার বাথরুম সারার কাজও আমিই সাহায্য করতাম। দেশের বাইরে থাকি তাই যেকোনো ধরনের কষ্ট যেকোনো ধরনের পরিস্হিতি মোকাবেলা করতে পারি। অনেক সময় আমার বোনকে বলতাম, তুমি উপরে থাকো আর আমি বাসা থেকে একটা বেড নিয়ে আসছিলাম আমি নিচে পড়ে থাকতাম। এরকম ১০ দিন গেছে আমি কোথাও কারো সাথে নূন্যতম যোগাযোগ করিনি, কথা বলিনি , শুধুমাত্র আমি মার পায়ের কাছে পড়েছিলাম। জানেন রেজা ভাই মারা যাওয়ার আগের দিন বিকেলবেলা মা অনেক হাসতেছিল চেহারায় যেন দ্যুতি বেরোচ্ছিল। একজন পরহেজগার, একজন পূন্যবতী মানুষ, একজন সফল মা। তার সন্তান হিসেবে টানা দশ দিন আমি তার শিয়রের কাছে রইলাম। যাবতীয় সেবা শুশ্রূষা করলাম, আম্মা আমার হাতেই মারা গেল। আবার আমি আমার কাঁধে লাশ নিয়ে দাফনে গেলাম। এজন্য সবসময় মনের ভিতর একটা আধ্যাত্মিক শান্তি কাজ করে আমার। মহান আল্লাহ তা'আলা আমাকে সৌভাগ্যবান করেছে, মাকে শেষ খেদমত করার সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করেননি।
আমার যে দুই বোন আমেরিকায় থাকে তারাও অসুস্থতার খবর পেয়ে চলে আসতেছিল কিন্তু তারা এসে মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পায়। আরেক ভাই তিনিও আমেরিকায় থাকেন মা মারা যাওয়ার সাথে সাথেই তিনি দ্রুত দেশে চলে আসেন।
আলম ভাই জানালেন, একবার তাঁর টাইফয়েড হয়েছিল। টানা দুই মাস হাসপাতাল ও বাসায় সেবাযত্ন করে তাঁকে সুস্থ করেছিলেন মা। এতে মা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রেজা ভাই , আমার এই মাকে সারাক্ষণ মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছে করতো।
আম্মা অনেক পর্দানশীল পরহেজগার মানুষ ছিল। মাগরিব নামাজ পড়তে বসে এশার নামাজ শেষ করে উঠতো। সারাদিন আল্লাহ আল্লাহ করত। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম রেজা ভাই, মা যখন মারা গেল চেহারার ভিতরে একটা অন্যরকম আভা দেখলাম। দাফনের সময় তখন অন্য কেউ যায় নাই। পরিবারের আমরা কয়েকজন দেখেছি, তিনি কেমন যেন হাসতেছিলেন, নুরানী একটা হলুদ চেহারা মুখে যেন পরম শান্তির মুচকি হাসি।
চট্টগ্রাম শহর থেকে পঞ্চাশ কিমি দুরে সাতকানিয়ার মহিশামুরা আমাদের গ্রাম। ওখানে আমাদের আব্বার নামে স্কুল, মসজিদ,মাদ্রাসা সবকিছুই আছে। আমি ইউএসএ থেকে চিটাগাং আসলে কখনো গ্রামে বেশি সময় থাকতাম না, কেবল এক দু'ঘণ্টার জন্য যেতাম। অথচ আম্মাকে কবরে শোয়ানোর পর আমি এ গ্রামের বাড়ী থেকে এক পাও নরছিনা, সারাক্ষণ কবরের পাশেই থাকতাম। মসজিদের সাথেই কবর, মসজিদে সময় কাটাতাম, নামাজ পড়তাম, শুধু কোরআন তেলাওয়াত আর মার কবর জিয়ারত এবং দোয়া করতাম। আমার সারাক্ষণের কাজই ছিল এটি। চল্লিশ দিন মোবাইল ফোন ব্যবহার কিংবা লোকজনের সহিত অতি জরুরী বিষয় ছাড়া আমার আর কোন কাজই ছিলনা।
আমাদের চট্টগ্রামে জিয়াফত নামে একটা অনুষ্ঠান হয়। মা র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাঁচ দিনের সে অনুষ্ঠানে গ্রামবাসী আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সাত- আট হাজার লোকের খাওয়ার আয়োজন করা হয়। আমার মা মেহমানদারী খুব পছন্দ করতেন। বাসায় মেহমান আসছে অথচ তারা না খেয়ে গেছে এমন কোন নজির রাখেনি মা । ঘরে আজ মা নেই, কিন্তু লোকজন আসছে প্রতিদিন, এমন ৪০ থেকে ৫০ জন মানুষ নিয়ম করে তিন বেলায় খাচ্ছে। এসবে কি যে ভাল লাগা সন্তান হিসাবে যেন মার ইচ্ছাগুলোই পূরণ করছি! আলম ভাই বলছিলেন এতে টাকার কোন ধরনের সমস্যা হচ্ছিলনা, ম্যানেজ হচ্ছেই। আমি দিচ্ছি ভাই-বোনরা দিচ্ছে।! ৪০ দিনের প্রগ্রামেও আড়াই থেকে তিন হাজার লোক খেয়েছে। মাঝে দু তিনটা শুক্রবার করেও তিন চারশো লোককে খাওয়ানো হয়েছে।
আমি ইউএসএ থাকি আমার একটা চাকুরি আছে, মনে হচ্ছিল মার মৃত্যুতে আমি তা টোটালি ভুলে গিয়েছিলাম। আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করছে, তুমি বিদেশে কবে যাবে? চাকরির কোন সমস্যা হবে না তো? আমার মা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। আমার জীবনে এর চেয়ে আর বড় ঘটনা হতে পারেনা, চাকুরী থাকুক আর নাইবা থাকুক। আমি ৪০ দিনের প্রোগ্রাম শেষ করে ৫৩ তম দিনে ইউএসএ এর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়ি ।
রেজা ভাই, এমন বিষয় আছে, এমন কিছু কথা আছে যা আপনাকে মা ছাড়া অন্য কেউ কখনো জিজ্ঞাসা করবে না,
বাবা খাইছিস?
কি দিয়া খাইছিস?
আহ! এই হলো মা!
শুধু আমি আপনি কেন মার অনুগ্রহ ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়৷
রেজা ভাই, আপনি হয়ত বলবেন বিদেশের কথা৷ কিন্তু বিদেশে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও আলাদা৷ সামাজিক নিরাপত্তাও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অনেক বেশি৷ এমনকি ইউএসএ তে বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাঁদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন – এটাই স্বাভাবিক৷ কর্ম-জীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এ জন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তাঁরা৷ কিন্তু, আমাদের দেশে? আমরা তো দেশকেও ‘মা' বলে ডাকি৷ দেশের মাটিকে মা জ্ঞান করে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকাই আমরা৷ বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য৷
কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়? বেঁচে থাকতে কতদিন, কতবার তাঁকে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি ‘মা, তোমায় ভালোবাসি'? জীবনচক্রের ঘূর্ণন শুরু হয় সেই জন্মলগ্ন থেকে৷ এরপর ছোটবেলা কাটিয়ে উঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু৷ এই ধ্রুব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্য৷ তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেয়া উচিত। যতদিন ‘মা' বেঁচে আছেন, কিংবা বেঁচে নেই ততদিনই মায়ের চেয়ে বড়, মায়ের চেয়ে আপন কোনকিছু নেই!
ভাই, যদি পারেন মার সাথে প্রতিদিন কথা বলবেন, মাকে সাথে রাখবেন অথবা আপনি গিয়ে উনার সাথে থাকবেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে আমি এমনও সন্তানদের দেখেছি মা অসুস্থ, কিন্ত কোন বিকার নেই! মা হয়তবা মারা গেছে অথচ কোন আবেগ নেই, বিরহ নেই, এমনকি তাদের দেশে আসার ন্যূনতম চেষ্টাটুকুও নেই। আবার চট্টগ্রামসহ দেশের আনাচে কানাচে অমানুষ টাইপের কুসন্তান রয়েছে যাদের মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ৩০ কিমি এর সামান্য রাস্তা ছয় ঘন্টা পরে শেভ করে বাবু সেজে দায়সারাভাবে শেষ মুহুর্তে কোনরকমে এসেছে।
আবার যেনতেন ভাবে কবরে কেবলমাত্র দু মুঠো মাটি দিয়ে যেন সব দায়িত্বের মহড়া শেষ করেছে সে!! বউ এর চাকুরী কিংবা অসুস্থ্যতার দোহাই দিয়ে মৃত বাড়ি থেকে সাথে সাথেই তার চলে যাবার নিমকহারামী দৃশ্যও দেখেছি!!
হায়রে অযোগ্য অকৃতজ্ঞ স্বার্থপর বেঈমান সন্তান!
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা