মরণপণ লড়াইয়ে ঠাকুরগাঁও পাক হানাদারমুক্ত হয় আজ

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:০৬ | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:৩৯

জুনাইদ কবির, ঠাকুরগাঁও

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে ৩ ডিসেম্বর অর্থাৎ একাত্তরের এই দিনে পাক হানাদারমুক্ত হয়েছিল দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে আজকের এই দিনে।

ঠাকুরগাঁও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সূত্রে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও তখন ছিল মহকুমা। বর্তমান ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানা ছিল এই মহকুমার অন্তর্গত। ৩ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঠাকুরগাঁও শহরে মানুষ জড়ো হতে থাকেন। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের জনপদ। হাজার হাজার মানুষ উদ্বেলিত কণ্ঠে ‘জয়বাংলা’ বলতে বলতে মুক্ত শহরের রাস্তায় বের হয়ে আসেন। এ সময় অনেকের হাতে ছিল প্রিয় স্বদেশের পতাকা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর সারা দেশের মতো ঠাকুরগাঁয়েও পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালায় নির্যাতন। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনে তারা মেতে ওঠে। একই সঙ্গে চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ! এরপর ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও।

এরই মধ্যে সংগঠিত হতে থাকেন ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিকামী মানুষ। তারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তুলেন দুর্বার প্রতিরোধ। ঠাকুরগাঁও তখন ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অস্তর্ভুক্ত। কমান্ডার ছিলেন বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার এম. খাদেমুল বাশার। এ সেক্টরে প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ২৯ নভেম্বর এই মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এরপর তারা শক্তি বৃদ্ধি করে সদলবলে প্রবেশ করে ঠাকুরগাঁওয়ে।

২ ডিসেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ লড়াইয়ে সে রাতেই শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে ২৫ মাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর ভোররাতে ঠাকুরগাঁও শহর শত্রুমুক্ত হয়।

জেলার শহর থেকে পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত গণকবর আর বধ্যভূমি।

কবি ও লেখক জুনাইদ কবির বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলার অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমিগুলোর এখন বেহাল অবস্থা রয়েছে। অযত্ন আর অবহেলার মধ্যে পড়ে থাকা গণকবরগুলো দেখার কেউ নেই। অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমি এখন গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। এসব বধ্যভূমি চিহ্নিত করা এবং সংস্কার করে ইতিহাস সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন।

প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা জানান, এই বধ্যভূমি ১৯৭১ সালে ২৩ এপ্রিল ১৮নং শুকানপকুর ইউনিয়নে ২ হাজার থেকে ২৫শ লোককে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে। আমরা এই শুকানপুকুর বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার দাবি জানাচ্ছি।

মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যক্ষদর্শী রাজাগাঁও ইউনিয়নের বিমলা রানী বলেন, ‘পাকিস্তনি বাহিনী আগে খরিলুপের বাড়িত আইছিল। খরিলুপের বাড়ি থেকে আসিল হামার বাড়ি। হামরা সবাই দৌড়াদৌড়ি করে পালানো। কিন্তু হামাক সবাকে ধরে নিয়ে আসিল হামার বস্তির তামাক লোকলাকে ধরে নিয়ে আসিছিল। সবাকে লাইন করে মারিক ৩১ জন ছিল। হামাক লাইক করে দাঁড়ায় থুইল কাহার নাক, কাহার লাগের গোস্তগেলা ছিড়ায় নিছে। ওই সময় মুই গর্বপতি ছিনু মিলিটারিরা বন্দুনটা দিয়ে মোর পেটটাত গুতা দিছে আর মুই কিছু কহিবা পারু না।’

ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে যারা এতটুকু কুণ্ঠিত হননি, আজ সেই সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ পাননি তাদের যথাযথ মর্যাদা।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকারই শহীদদের স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়ে গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দু’একটি জায়গায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও সেগুলো অযত্নের মধ্যে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

ঢাকাটাইমস/০৩ডিসেম্বর/ইএস