কাটাছেঁড়া করা সংবিধান অনুযায়ী কোনো নির্বাচন হবে না: মির্জা ফখরুল

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:০২

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের জবাব দিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেছেন, কোন সংবিধান? যেখানে বারবার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে নিজের প্রয়োজনে। সেই সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলতে পারে না। তারা এই সংবিধানের অনেক পরিবর্তন করেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্যথা এ দেশে কেনো নির্বাচন হবে না। অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এরপর নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। যেই সরকার নতুন স্বপ্ন দেখাবে।’

রাজশাহী নগরীর মাদরাসা মাঠে শনিবার বিকালে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম এসব কথা বলেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ফেসবুকে পোস্ট দিলেও উস্কানি হিসেবে আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং জামিন নেই। আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সবার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটা চায় না। তাদের লক্ষ্য যেমন করে পারো বন্দুক-পিস্তল দিয়ে ক্ষমতায় থাকো। আমরা তো তাদের চাকর নই। এই দেশের মালিক জনগণ।’

বিএনপি নেতাকর্মীদের জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং নিহত সহযোদ্ধাদের রক্তের বদলা নিতে হলে আমাদেরকে জেগে উঠতে হবে। দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।’

বিএনপির চলমান লড়াই সংগ্রামে দলটির ছয় শতাধিক নেতাকর্মী গুম হয়েছে দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘পাবনার ঈশ্বরদীতে জাকারিয়া পিন্টুসহ নয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এতদিন পরে সাজা দিয়ে বিরোধী দলকে নির্মূল করতে চায় সরকার। কিন্তু বিরোধী দল আরো নতুনভাবে উদ্যমী হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন লুটেরা দলে পরিণত হয়েছে। নিজেরা লুট করে পাহাড় বানাচ্ছে আর সাধারণ মানুষকে গরিব করছে। কদিন আগেই পাবনার কয়েকজন কৃষককে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ ক্ষমতাসীনরা ব্যাংক লুট করে দিচ্ছে। খাজাঞ্চিখানা শুন্য করে দিচ্ছে। কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয় না। ইসলামী ব্যাংকের টাকা নামে বেনামে ঋণের নামে লুট করছে।’

আওয়ামী লীগ দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করেছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তারা কেয়ারটেকারের দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে মানুষ মেরেছে। পাঁচবার কেয়ারটেকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে সমস্যা হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই ব্যবস্থা বাতিল করেছে।’

ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকার ঢাকার সমাবেশ নিয়ে ভয় পেয়েছে। আমরা নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চাই। তারা তাদের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ঘুম হারাম করে ফেলেছে। তারা আতংকে ভুগছে।’

‘আমরা নয়াপল্টনে অসংখ্য সমাবেশ করেছি। সেখানে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন। কই তখন তো কোনো সমস্যা হয়নি। এখন তারা জঙ্গি নাটক শুরু করেছে। নিজেদের প্রয়োজনে জঙ্গি বানায়। নিজেরাই বাস পুড়িয়ে অগ্নিসন্ত্রাস করে। এই হচ্ছে আওয়ামী লীগ।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনারা কি এই দেশের সন্তান নন? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বাড়ি গাড়ি বানান। কেন নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন করেন? খবরদার আর নিপীড়ন করবেন না। আপনারা হলেন জনগণের সেবক।’

‘আপনাদের উচিত ছিল নেতাকর্মীদেরকে সহযোগিতা করা সেখানে আপনারা পানি বিদ্যুৎ ও খাবার বন্ধ করেছেন। কেন আপনারা এতো অমানুষ? এভাবে সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। আপনারা বিধান মেনে চলুন। অন্যথায় দেশের মানুষ কিন্তু কোনো অন্যায় সহ্য করবে না।’

বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, আজকে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ক্ষমতাসীনরা দেশের সবকিছু লুটে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। ডলারের দাম এখন আকাশচুম্বী। কারণ সবই তো কানাডা আর মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে।’

‘১১ বছরে ১৯ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। আর বলে মেগা উন্নয়ন করেছে। অথচ কৃষক সার পায় না। ফসলের দাম পায় না। ঘরে ঘরে চাকরি নেই। দশ টাকায় চাল নেই। কারণ সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আজকে ধানের শীষে রক্ত মিশেছে। এই রক্ত দূর করে ধানের শীষ পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের আন্দোলন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। আমাদের আন্দোলন জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন। একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আন্দোলন।’

‘আমরা আর কষ্ট করবো না। এই ভয়াবহ দানব সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ঠিক থাকবে না। ১৪ বছর ধরে আমরা নির্যাতিত। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো তাদের বাবা ও স্বজনদের জন্য অপেক্ষায় থাকে।’

রাজশাহীর ইতিহাস আন্দোলনের ইতিহাস মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই রাজশাহীতে অনেক বরেণ্য মানুষের জন্ম হয়েছে। তেভাগা আন্দোলনের সূতিকাগার বৃহত্তর রাজশাহী। এই অঞ্চলে জন্মেছেন দুই মহানায়ক। একজন মওলানা ভাসানী আরেকজন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।’

‘বিভাগীয় গণসমাবেশে যোগ দিতে যারা তিনদিন ধরে কনকনে শীত উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করেছেন। খেয়ে না খেয়ে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। তাদেরকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই সরকার তো আগের রাতেই ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় আছে। বিদেশিরাও বলছে তারা ভোট চোর। আসলে তাদের কোনো লজ্জা নেই।’

তিনি বলেন, ‘গত ২ বছরে ১২ হাজার নতুন কোটিপতি বেড়েছে। অন্যদিকে সাড়ে ৩ কোটি মানুষ আরো গরিব হয়েছে। তাহলে সরকার কার উন্নয়ন করেছে? আজকে দেশের খেটে খাওয়া মানুষ শান্তিতে নেই, যারা হালাল উপার্জন করে। যারা ঘুস খায়, অবৈধ উপার্জন করে তারা কেবল সুখে আছে।’

আওয়ামী লীগকে চোরের দল মন্তব্য করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন—সবাই পায় সোনার খনি আমি পেলাম চোরের খনি। আাট হাজার কেজি চালসহ আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে। আসলে শেখ মুজিব নেই কিন্তু চোরগুলো রয়ে গেছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘রাজশাহীর সমাবেশ থেকে প্রমাণিত হয় শেখ হাসিনার সরকারকে দেশের জনগণ আর চায় না। এই সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। আজকে জনগণ সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়েছে। সরকার এখন আতংকিত। ইনশাআল্লাহ, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ থেকে সরকারকে পদত্যাগের এক দফার কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘জনগণই আপনাদের বিরুদ্ধে খেলবে। আপনাদের খেলা বন্ধ করুন। আজকে দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। জনগণের টাকা লুটে বিদেশে পাচার করে আরাম আয়েশ করছে। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ হাহাকার করছে। দেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছিলাম আজকের বাংলাদেশের জন্য নয়। আজকে একটি সমাবেশ করতে হলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয় এবং জনগণ তিনদিন আগেই এসে তাঁবুতে আশ্রয় নেয়। এটা কি সেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ? আজকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন করতে হচ্ছে।’

‘তবে মানুষের ভোটাধিকার ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ করবো। রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশের যদি আওয়ামী লীগ করার ইচ্ছা হয় তাহলে পোশাক ছেড়ে রাস্তায় এসে বিএনপির সাথে লড়েন। দেখা যাবে কে জেতে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আপনাদের পরিবার চলে। সুতরাং আমাদের রক্তচক্ষু দেখালে ভয় পাই না।’

বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘সমাবেশ ঠেকাতে সরকার গায়েবি মামলা দিয়েছে। পরিবহন ধর্মঘট করেছে। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। তবুও আমাদের সমাবেশ মহাসমাবেশে রূপ ধারণ করেছে।’

তিনি বিএনপি নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা সরকারকে হলুদ কার্ড দেখান।’ পরে নেতাকর্মীরা হলুদ ক্যাপ উুঁচু করে ধরেন। রাজশাহীর সমাবেশে যারা পরিশ্রম ও কষ্ট করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান দুলু।

এর আগে সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানের বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় গণসমাবেশ শুরু হয়। বিএনপির রাজশাহী মহানগরীর আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ আলী ঈশার সভাপতিত্বে ও মামুনুর রশিদ ও শ্রী বিশ্বনাথ সরকারের পরিচালনায় গণসমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নেতা মিজানুর রহমান মিনু, মো. শাহজাহান মিয়া, আব্দুল মান্নান তালুকদার, হাবিবুর রহমান হাবিব, কর্নেল এম এ লতিফ খান, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শাহিন শওকত, ওবায়দুর রহমান চন্দন, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, নাদিম মোস্তফা, অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন, আবু সাঈদ চাঁদ, তোফাজ্জল হোসেন তপু, আবু বকর সিদ্দিক, ফজলুর রহমান খোকন, যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আতিকুর রহমান রুমন, ছাত্রদলের সাইফ মাহমুদ জুয়েল, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ, ওলামা দলের শাহ মোহাম্মদ নেছারুল হক, শ্রমিকদলের আনোয়ার হোসাইন, কাজী মো. আমীর খসরু, মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, নওগাঁ জেলার আবু বকর সিদ্দিক নান্নু প্রমুখ।

উল্লেখ্য, চাল, ডাল, জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি, চলমান আন্দোলনে ভোলায় নূরে আলম ও আব্দুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সিগঞ্জে শহিদুল ইসলাম শাওন ও যশোরে আব্দুল আলিম মোট ৫ জন হত্যার প্রতিবাদে, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রতিবাদে সারাদেশে বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা দেয় বিএনপি।

(ঢাকাটাইমস/০৩ডিসেম্বর/ডিএম)