শীতে রোগ নিরাময়ে কার্যকরী মহৌষধি ভেষজ আমলকি

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:৪৭ | প্রকাশিত : ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:১৩

শীতের মৌসুমে ফ্লু থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। কারণ এ সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শীতে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। শীতের সময় সুস্থ থাকতে প্রাকৃতিক ভেষজ আমলকির জুড়ি নেই। সুপারফুড আমলকির মধ্যে উপস্থিত ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট একাধিক রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারে।

শতাব্দী প্রাচীন আয়ুর্বেদ অনুযায়ী আমলকি হল মহাঔষধি। সকালবেলা খালি পেটে একটু আমলকির রস বা নাশতা খাওয়ার পর এক টুকরো আমলকির গুণে অনেক রোগ নিরাময় হয়ে যায়। বাইরে থেকে ওষুধ খেলে সাময়িক লাভ হয় ঠিকই। কিন্তু আমলকি ভিতর থেকে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদে ভোজনের আরম্ভে, মধ্যভাগে এবং শেষে নিয়মিত আমলকী খেতে বলা হয়েছে। এই ফলের গুণ অমৃত সমান-সেই জন্য একে অমৃতফলও বলা হয়।

আমলকি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ফাইলান্থাস অ্যামব্লিকা। ছোট বা মাঝারি আকারের পাতাঝরা বৃক্ষ। এ গাছ ১০-২০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছের বাকল স্তরবিশিষ্ট। শীতকালে আমলকির পাতা ঝরে যায়।

আমলকির জন্মস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। পাহাড়ের প্রায় এক হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতায়ও এ গাছ জন্মে থাকে। পাতা পক্ষল ও যৌগিক। বোঁটার দুই পাশে চিরুনির দাঁতের মতো সাজানো থাকে। আমলকী ফুল একলৈঙ্গিক। পুরুষ ফুল বোঁটাযুক্ত। এ ফুল ডালের ওপরের দিকে ধরে, আগে আসে এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। স্ত্রী ফুল বোঁটাহীন ও ডালের নিচের দিকে ধরে। ফুল আকারে খুবই ছোট, খালি চোখে দেখা কষ্টসাধ্য। স্ত্রী ও পুরুষ ফুল একই শাখায় প্রস্ফুটিত হয়। আমলকি বায়ুপরাগায়িত।

আমলকি ফল মৃদু শিরাবিশিষ্ট, গোলাকৃতি, মাংসল ও রসাল। ফলের রং হালকা সবুজ বা হলুদ। ভেতরে ছয়টি বীজের সমষ্টির একটি কঠিন আঁটি থাকে। এ উপমহাদেশে আমলকীর বেনারসি জাতটি সবচেয়ে ভালো। ফল পাকে শীতকালে। আমলকি ফলের প্রতি ১০০ গ্রামে ৮১ গ্রাম পানি, ০.৫ গ্রাম আমিষ, ১৪ গ্রাম শ্বেতসার, ০.১ গ্রাম স্নেহ, ০.৭ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ৩.৫ গ্রাম আঁশ, ০.০৫ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.০২ গ্রাম ফসফরাস, ১.৫ গ্রাম আয়রন, ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি এবং ১৪০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে। প্রতি ১০০ গ্রামে ৫৯ কিলোক্যালরি তাপশক্তি বিদ্যমান।

১০০ গ্রাম আমলকীতে ভিটামিন সি আছে ৪৬৩ মিলিগ্রাম। আমলকীতে পেয়ারার তিন গুণ ও কাগজি লেবুর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভিটামিন সি রয়েছে। এ ছাড়া কমলার চেয়ে ১৫, আপেলের চেয়ে ১২০, আমের চেয়ে ২৪ ও কলার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি ভিটামিন সি রয়েছে এতে।

আমলকি প্রক্রিয়াজাত করলে ভিটামিন সি-এর পরিমাণ কমে যায়, তবে আমলকির অ্যাসকরবিক এসিড স্থায়ী। কেননা, এটা ট্যানিন ও অ্যান্থোসায়ানিন দিয়ে আবৃত থাকায় সহজে অক্সিডেশন হয় না। নিষ্কাশিত ফলের রসের ভিটামিন এক সপ্তাহ পর্যন্ত অবিকৃত থাকে। একটু সচেতন হলে প্রতিটি বাড়িতে একটি আমলকি গাছ রোপণ করলে ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য ভিটামিন সি-এর ভালো উৎস আমরা রেখে যেতে পারি। আমলকির জেলি, মোরব্বা বেশ সুস্বাদু। ফল ফালি করে কেটে রোদে শুকিয়ে লবণ, জোয়ান ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে মুখশুদ্ধি হিসেবে ব্যবহার হয়।

শীতকালে প্রতিদিন দুটো করে আমলকি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ভেষজ যত ফল রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উপরেই আছে এই ছোট্ট ফলটি। চুলের জেল্লা বৃদ্ধি, রুক্ষতা কমানো, ত্বকের উজ্জ্বলতা, পেটের গোলযোগ দূর, শরীর চাঙ্গা এমন হাজারও সমস্যার সমাধান করে আমলকি। সকালে কাঁচা আমলকি, বা ভাতে সিদ্ধ করে আমলকি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। জেনে নিন ভেষজ আমলকির স্বাস্থ্য উপকারিতা-

রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। আমলকি কেটে কাঁচা খেতে পারলে খুবই ভাল। তবে এখন আমলকির রসও পাওয়া যায়। ভাল মানের আমলকির রস খেতে পারলেও একই কাজ হবে। সাধারণ ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি, সংক্রমণ ছাড়াও হার্টের সমস্যা, ক্যানসারের মতো রোগও ঠেকিয়ে রাখা যায় নিয়মিত আমলকির ব্যবহারে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে। গরম থেকে ঠান্ডা এবং ঠান্ডা থেকে গরম পড়ার মুখে অনেকেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন। ইসবগুল, ওষুধ খেয়েও অনেক সময়ে উপকার হয় না। সেই সময়ে আমলকি কিন্তু বিশেষ ভাবে কাজে আসে। হজম সংক্রান্ত সমস্যা দূর করে কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখে আমলকি।

নিয়মিত আমলকি খেলে ত্বক সুস্থ থাকে। নানা রকমের চর্মরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়াও এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে আমলকি খুবই উপকারী। এছাড়া চোখ লাল হওয়া, চুলকানো ও চোখ দিয়ে পানি পড়া রোধেও আমলকি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

আমলকীতে প্রচুর পরিমাণে ক্রোমিয়াম থাকায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ওষুধের পাশাপাশি রোজ দুটো করে আমলকী ডায়েটে রাখতে পারেন।

আমলকি শরীরের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে ব্যাথা বেদনা কমিয়ে দেয়। এক গ্লাস পানিতে দু চামচ আমলকী বেটে, দু’চামচ মধু দিয়ে খেলে সর্দি কাশিতে খুব আরাম হয়। এছাড়া দেহের অতিরিক্ত মেদ দূর করতে আমলকি বেশ কার্যকরী।

আমলকিতে ভিটামিন সি ও অ্যামিনো অ্যাসিড যা চুল পড়া কমানোর পাশাপাশি বাড়ায় চুলের বৃদ্ধি। খুশকি দূর করতেও এর জুড়ি নেই। চুল এবং ত্বকের স্বাস্থ্য মজবুত রাখে আমলকী।

আয়ুবের্দিক হেয়ার টনিক হিসবে আমলকির জুড়ি নেই। অকালপক্কতা দূর করে নতুন চুল গজাতে এটি বেশ কার্যকর। এক্ষেত্রে আধা কাপ আমলকির সঙ্গে ১ কাপ পানি ও ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে একঘণ্টা রেখে দিন। তারপর চুল শ্যাম্পু করে দ্রবণটি দিয়ে ধুয়ে নিন। ৫ মিনিট অপেক্ষা করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে আপনার চুল পড়া বন্ধ হবে।

চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে ১ টেবিল চামচ আমলকির সঙ্গে ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। এবার পেস্টটি ভেজা চুলে ম্যাসাজ করুন। ৩০ মিনিট পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে আপনার চুল হয়ে ওঠবে ঝলমলে।

আমলকি যেভাবে খেলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাবেন

গরম পানিতে মধুর সঙ্গে প্রতিদিন আমলকির গুঁড়া মিশিয়ে খেতে পারেন। আমলকি ছেঁচে তার থেকে রস বার করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেতে পারেন। আমলকি দিয়ে বানিয়ে নিতে পারেন আচার। চিনি খেতে যদি সমস্যা না থাকে, সে ক্ষেত্রে বানিয়ে নিতে পারেন আমলকির মোরোব্বা। আমলকি কেটে রোদে শুকিয়েও খাওয়া যেতে পারে।

আমলকি বেশি খেলে হতে পারে হীতে বিপরীত

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যাদের অম্বলের সমস্যা খুব বেশি, নিয়মিত আমলকি খেলে তাদের সেই সমস্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা থাকে। যাদের রক্ত পাতলা হয়ে যাওয়ার সমস্যা আছে, তাদের আমলকি না খাওয়াই ভালো। রক্ত আরও পাতলা হয়ে যেতে পারে। আমলকিতে রক্ত বন্ধ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। রক্তপাত বন্ধ না হলে টিস্যু হাইপক্সেমিয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।

দিনে দু'-একটির বেশি আমলকি খাওয়া ঠিক নয়। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। এর জেরে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে কার্ডিয়াক সমস্যাযুক্ত কোনও সমস্যা থাকলে এই ফলটি ব্যবহার করার আগে তাদের চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।

আমলকি শরীরের তাপমাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। সুতরাং আমলকি অধিক পরিমাণে খেয়ে ফেললে জ্বর-সর্দি হতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/৬ ডিসেম্বর/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :