আমেরিকায় মানবাধিকার

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:৪৪

পুলিশি নির্যাতনে ২০১৬ সনে ১০৭০ জন, ২০১৭ সনে ১০৯১ জন, ২০১৮ সনে ১১৪৪ জন, ২০১৯ সনে ১০৯৪ জন এবং ২০২০ সনে ১১২৪ জন মানুষ আমেরিকায় নিহত হয়। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতি দিন কমপক্ষে ৩ জন মানুষ পুলিশি নির্যাতনে আমেরিকায় নিহত হয়। প্রতি বছর পুলিশের হাতে ১০ মিলিয়ন জনগণ গ্রেপ্তার হয়ে থাকে।

অন্য একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৩-২০২২ সালে আমেরিকার পুলিশের বিরুদ্ধে ৯৯১১ জনকে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়। কাজেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সম্যক ধারণা করার ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত তথ্য উপাত্তই যথেষ্ট। সে কারণেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যখন সভ্য রাষ্ট্রের মুখোশ পড়ে অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন করে, বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র আমেরিকার মূল্যায়নকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে।

এর পিছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, যারা নিজের দেশের মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে ব্যর্থ, রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানে অপারগ তাদের মতামত আমলে নেওয়া গুরুত্বহীন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের উচিত হবে, আমেরিকা নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা কারণ একবিংশ শতাব্দীর এ সময়েও বর্ণবৈষম্যের ব্যাপকতা রয়েছে দেশটিতে।

জেমস কার্ডেন ‘যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের কট্টর মনোভাব বন্ধ করেছে মীমাংসার পথ’ এ শিরোনামে একটি কলাম লিখেন। অথচ ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন, ২৩ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক ও বেসামরিক খাতে আরও কয়েক শ কোটি ডলারের সহযোগিতা দেবে। অর্থাৎ সংকটকে আরো ঘনীভূত করার প্রক্রিয়ায় সকল ধরনের মসলার রসদ সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ডলার দেওয়া হবে ‘নিরাপত্তা সহায়তা’ হিসেবে। ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য অগ্রসর প্রযুক্তির ৬টি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, লেজার নিয়ন্ত্রিত রকেট ব্যবস্থা, ২ লাখ ৪৫ হাজার রাউন্ড ১৫৫ মিলিমিটার আর্টিলারি গোলা ও ৬৫ হাজার রাউন্ড ১২০ মিলিমিটার মর্টারের গোলা সহায়তা হিসেবে ইউক্রেনকে দেওয়া হবে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রাণঘাতী অস্ত্র ও মানবিক কাজে কিয়েভকে মোট ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের অনমনীয় মানসিকতার যুদ্ধে শর্তহীনভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে (দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০২২)।

সুতরাং যে রাষ্ট্রটি যুদ্ধের দামামাকে জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটার পায়তারা করে তথা প্রতিপত্তিকে সবার সামনে উপস্থাপন করতে চায় সে রাষ্ট্রটি কখনোই কল্যাণকর পৃথিবী প্রত্যাশা করে না। কাজেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কোন বিবৃতিতে খুব সাড়া দেওয়ার তেমন অবকাশ নেই। কেননা কল্যাণকর পৃথিবীর স্বার্থে আপনি যদি কাজ করতে ব্যর্থ হন তাহলে আপনার ফতোয়া কেউই মানবে না।

আমেরিকায় নিরস্ত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর একজন পুলিশ অফিসার হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরার পর ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। মিনিয়াপোলিস অঙ্গরাজ্যের একটি রেস্তোরায় নিরাপত্তাকর্মী হিসাবে কাজ করতেন ৪৬ বছর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েড। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় জর্জ ফ্লয়েড নিঃশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে বলেছিলেন, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না এবং পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মৃত্যু হয়। নির্বিচারে হত্যার এমন নিদর্শন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অহরহ ঘটে থাকে এবং এমন অনেক ঘটনাই আছে যেসব লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। সঙ্গত কারণেই পৃথিবীর বিখ্যাত গণমাধ্যমে নিউজগুলো আসে না নিয়মিত।

ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন এবং বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। বিষয়টি যে উদ্দেশ্যমূলক এবং পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে সেটি সহজেই বুঝা যায় এবং একটি পক্ষকে সবসময়ই ভিক্টিম বানানোর পায়তারা করা হয়। ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামে একটি সংস্থার জরিপে দেখা যায়, আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যায় কৃষ্ণাঙ্গরা। এই যে একটা বৈষম্য, বর্ণবাদের বিচরণ, একটি পক্ষকে দমিয়ে রাখার হীন প্রচেষ্টা এসব কি কোনো সভ্য দেশ লালন করতে পারে? গায়ের রং এর কারণে মানুষকে মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন করার কোন মানে কিন্তু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

মিসৌরিতে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসনের সঙ্গে ১৮ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ মাইকেল ব্রাউনের এক বাদানুবাদের জেরে ওই পুলিশ অফিসারের গুলিতে নিহত হন ব্রাউন। মিসৌরির ফার্গুসন এলাকার একটি বিক্ষোভে মারা যায় এক ব্যক্তি, আহত হয় অনেক এবং কয়েক শ লোককে ধরপাকড় করা হয়।

দক্ষিণ ক্যারোলাইনার নর্থ চালর্সটনের ৫০ বছর বয়স্ক কৃষ্ণাঙ্গ এক ব্যক্তি ওয়াল্টার স্কট যখন পুলিশ অফিসার মাইকেল স্ল্যাগারের কাছ থেকে ছুটে পালাচ্ছিলেন তখন তাকে পিঠে তিনবার গুলি করা হয় এবং মারা যান মি. স্কট। এসকল ঘটনা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিতভাবেই হচ্ছে।

টেক্সাস রাজ্য পুলিশ বাহিনীর সদস্য ব্রায়ান এনসিনিয়া ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের ছোটখাট এক অভিযোগে ২৮ বছর বয়স্ক সান্ড্রা ব্ল্যান্ডের গাড়ি থামায়। তিনদিন পর কারাগারে আত্মহত্যা করেন সান্ড্রা। ডালাসের ফোর্থ ওয়ার্থে ২৮ বছর বয়সী আতাতিয়ানা জেফারসনকে তার নিজের শোবার ঘরে গুলি করেন পুলিশ অফিসার অ্যারন ডিন। ব্রেওনা ২৬ বছর বয়সী জরুরি চিকিৎসা বিষয়ক একজন প্রকৌশলী লুইভিলের কেন্টাকিতে তার ফ্ল্যাটে ঢুকে পুলিশ অফিসাররা তাকে আটবার গুলি করে।

অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি নিউইয়র্ক এখন নতুন সংকটের মুখোমুখি। নিউইয়র্কে সহিংস ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে করোনাকালীন দুর্যোগ এবং জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে অস্ত্র সহিংসতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। এতে চারজন নিহত ও ৪১ জন আহত হয়েছেন। কাজেই সেখানে মানবাধিকার চরম লঙ্ঘন হচ্ছে, সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীণতায় ভুগছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর থেকে মানুষের আস্থা ক্রমান্¦য়ে উঠে যাচ্ছে এবং প্রত্যেক ঘরে নিরাপত্তার জন্য লাইসেন্সধারী অস্ত্র রয়েছে।

নিউইয়র্ক নগরীতে সহিংসতায় মাউন্ট সিনাই সেন্ট লুক হাসপাতালে ২৩ বছর বয়সী একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রতি উত্তরে পুলিশ বলছে, পিঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ব্রুকলিনের সাটার অ্যাভিনিউয়ে ৪০ বছর বয়সী এক লোক বুকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। একই সময়ে ইস্ট ফ্ল্যাটবুশে দুই তরুণও গুলিবিদ্ধ হয়। এছাড়া গুলিবিদ্ধ ১৯ বছর বয়সী কিশোরীকে হাসপাতালে মৃত ঘোষণা করা হয়।

ইস্ট নিউইয়র্কের অ্যাটকিনস অ্যাভিনিউয়ে গুলিবিদ্ধ ২০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এ ধরনের সহিংস ঘটনার চিত্র প্রতিচিত্র আমেরিকার বড় বড় শহরগুলোতে প্রায়শই ঘটে থাকে, অনেক বিষয় আবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে না আসায় পৃথিবী মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকৃত তথ্য জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

উপরোক্ত ঘটনাগুলোতে প্রতীয়মান হয় যে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার পরিস্থিতি সুখকর নয়। সাধারণ মানুষের মানবাধিকারের বালাই নেই, সাদাকালো গায়ের বর্ণবৈষম্য ইত্যাদি ঘটনার চিত্র উঠে এসেছে। এ বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গণমাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতিসংঘসহ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ও কর্মীদের ব্যাপকভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যেতে হবে।

আমার মনে হয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। যাতে করে একেবারে শুরু থেকে কাজ শুরু করা যায়। সাধারণ মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতের ব্যাপারে সকল ধরনের অনুষঙ্গের নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই মূলত মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্বস্থি পেতে পারে।

তবে আর একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি প্রদানের বিষয়টি। পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রে কোন ধরনের ঘটনা ঘটলেই তারা সাথে সাথে বিবৃতি দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, আইনের শাসনের ব্যত্যয় হচ্ছে, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে দেদারছে মন্তব্য প্রদানে সিদ্ধহস্ত রাষ্ট্রটি। অথচ নিজের দেশের শিক্ষার্থীরা স্কুলে নিরাপদ নয় সে বিষয়ে যেন তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। এ কারণেই পুরো পৃথিবীতে আমেরিকার মোড়লগিরি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং তারা কিন্তু তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে কারণেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে নিজ দেশের জনগণের মানবাধিকার সুনিশ্চিতে কাজ করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ বিষয়গুলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সাপেক্ষে তাদের উচিত অন্যদেশের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :