মেসিতে মিশেছিল সব পথ

তারিক আল বান্না
 | প্রকাশিত : ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ২২:৫৬

কাতার বিশ্বকাপের পর্দা উঠার আগেই যেসব সমর্থক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্রাজিলের পক্ষে বারবার স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে ব্রাজিলের সাফল্য কামনা করে অনবরত বিবৃতি প্রদান করেছেন, তারাই হঠাৎ করে ফাইনালের আগে বা পরে মেসি বন্দনায় নিজেকে উজার করে দিলেন। ঘটনাটা বেশ মজার! মেসির কারণেই অনেকে ফাইনালে আর্জেন্টিনার সমর্থক বনে যান। সকলের ক্ষেত্রে না হলেও এই পরিবর্তিত সমর্থন উল্লেখ করার মতোই। বিশ্বকাপের আয়োজক কাতার থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দৃশ্য দেখা গেছে। যেন এক লিওনেল মেসিতে মিশেছিলো সকল পথ। সকলের চাওয়া ছিল একটাই, মেসির হাতে উঠুক বিশ্বকাপ ট্রফি। হয়েছেও তাই। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা ও আকর্ষণীয় ফাইনালে ২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে মেসির আর্জেন্টিনা।

এ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচগুলো ল্যাটিন আমেরিকা বনাম ইউরোপ, নয়তো ইউরোপ বনাম ইউরোপ, নয়তো ল্যাটিন আমেরিকা বনাম ল্যাটিন আমেরিকা। সেখানে বিশ্বের অন্য কোনো মহাদেশ বা অঞ্চলের দেশের নাম নেই। এবারের কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে খেললো ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা ও ইউরোপের ফ্রান্স। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ঐতিহাসিকভাবেই পরষ্পরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যকার তিক্ততার কথা সবাই জানে। অথচ, ফাইনালের আগে মেসির পাশে এসে দাঁড়ান বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল তারকা খেলোয়াড় নেইমার, সাবেক তারকা রিভালদো, রোনালদো নাজারিও, রোনালদিনহো, কাকা, কাফুসহ ব্রাজিলের অনেকেই। ২০০২ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপজয়ী দলের তারকা রোনালদো তো বলেই ফেলেন, ব্রাজিলের সমর্থকরাও গলা ফাটিয়েছেন মেসির পক্ষে। আর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার পর সবার আগে তাকে ও তার দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন খোদ নেইমার।

বাংলাদেশে বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে যেখানে আর্জেন্টিার পতাকা, সেখানেই প্রতিপক্ষ সমর্থকরা উড়িয়েছেন ব্রাজিলের পতাকা। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে বাংলাদেশে। সেটা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা যেভাবে পরষ্পরের শত্রু হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনটাই ছিল বিশ্বকাপের সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে পাশাপাশি চলেছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মিছিল। তবে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ ও ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল দল ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে শেষ আট থেকে বিদায় নেওয়ার পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ফাইনাল ম্যাচ চলাকালে ব্রাজিল দলের সমর্থকরাও আর্জেন্টিনার সাফল্য কামনা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালসহ এবারের আসরের শিরোপা জেতার জন্য আর্জেন্টিনাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছেন তারা। আর এটা হয়েছে একমাত্র মেসির কারণেই। সাত বারের ব্যালন ডি-অর জয়ী মেসির প্রতি যে এতো ভালোবাসা মজুদ ছিল, তা হয়তো জানেন নামেসি নিজেও। কিন্তু তিনি সব দেখেছেন ও শুনেছেন।

গেল শতাব্দীর বিশ্বসেরা খেলোয়াড় দিয়েগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা তাদের দ্বিতীয় শিরোপা জেতার পর সারা বিশ্বে দলটির সমর্থন বহুগুন বেড়ে যায়। কিন্তু টানা কয়েকটি বিশ্বকাপ আসরে তাদের শিরোপা না জেতায় সমর্থনে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে। আর নতুন প্রজন্মের সমর্থকরা অনেকেই নেইমারের খেলায় মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিলের সমর্থক হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে ব্রাজিলের সমর্থক বেড়েছে। এই নেইমার ও মেসি আবার ফ্রান্সের প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন (পিএসজি) দলের খেলোয়াড়। তাদের মধ্যেও দারুণ বন্ধুত্ব রয়েছে। সব মিলে এমনও হয়েছে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা নেইমারকে বেশ পছন্দ করেন, আবার ব্রাজিলের সমর্থকরাও মেসিকে বেশ পছন্দ করেন। ফলে ফাইনালে নেইমারের দল না থাকলেও মেসির দল থাকায় সকলের সমর্থনও ঘুরে যায় আর্জেন্টিনার দিকে। এটা কেবল বাংলাদেশেই নয়। আয়োজক দেশ কাতারেও তা দেখা গেছে। এ কারণেই ফাইনালে গ্যালারীতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ দর্শক আজেন্টিনার পক্ষে ছিলো। সেটাই কারণ একটাই, মেসি।

এবারের বিশ্বকাপে মেসি অসাধারণ খেললেও আর্জেন্টিনা গ্রুপপর্বে তাদের প্রথম ম্যাচে ১-২ গোলে হেরে যায় এশিয়ান শক্তি সৌদি আরবের কাছে। যেখানে ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন মেসি। এরপর কনকাকাফ অঞ্চলের দেশ মেক্সিকোর বিপক্ষে আর্জেন্টিনা তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে ২-০ গোলে জয়লাভ করে। ঐ ম্যাচে মেসি ৬৪তম মিনিটে দলের প্রথম গোলটি করেন। আর দ্বিতীয় গোলটি তৈরি করেও দেন মেসি। বলা যায় মেসিময় জয়। গ্রুপপর্বে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা। ঐ ম্যাচে গোল না করলেও মেসি ছিলেন দলের মধ্যমনি। গ্রুপপর্ব শেষ হতে অনেকেই মন্তব্য করেন, বিশ্বকাপটা মেসির হাতেই যাচ্ছে।

নকআউট পর্বে আর্জেন্টিনা অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে শেষ আটে জায়গা করে নেয়। এই ম্যাচে মেসি একটি গোল করেন। আর দ্বিতীয় ম্যাচেও তার অবদান ছিল অনেক। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে জিততে বেশ বেগ পেতে হয়। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে খেলা ২-২ গোলে ড্র ছিল। সেখানে দলের পক্ষে একটি গোল করেন মেসি। আবার টাইব্রেকারেও গোল মিস করেননি এই ফুটবল জাদুকর। সেমিফাইনালে মেসির খেলা ছিল চোখ জুড়ানো। নিজে একটি গোল করেন। আর একটি গোল যেভাবে তৈরি করে দেন তা ছিল অবিশ্বাস্য। ফাইনালেও দারুণ খেলেন মেসি। ফাইনালের ১২০ মিনিটের খেলা ৩-৩ গোলে ড্র থাকে। তাতে মেসি একাই দুটি গোল করেন। আবার টাইব্রেকারেও গোল করেন মেসি। অবশ্য প্রতিপক্ষ ফ্রান্স দলের কিলিয়ান এমবাপ্পে মূল ম্যাচে একাই তিনটি গোল করেন এবং টাইব্রেকারেও গোল করতে ভুল করেননি। তবে শেষ হাসিটা হাসেন মেসিই।

মেসি তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন এবং ভাগ্যও তার পক্ষে ছিলেন। দুইয়ে মিলে এবারের বিশ্বকাপটা শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়ে মেসিময় আসর। ম্যারাডোনা যখন ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জেতেন, তখন মেসির জন্মও হয়নি। যখনই বুঝতে শিখেছেন, তখন থেকেই তিনি ম্যারাডোনার মতো হতে চেয়েছেন, হয়েছেনও। আর্জেন্টিনার হয়ে ১৭২ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৯৮টি। ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার শিরোপা লাভ করে মেসির আর্জেন্টিনা। এর মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মেসি জিতলেন ফুটবলের বিশ্বযজ্ঞ বিশ্বকাপ। আর এতো বেশি প্রশংসা কুড়াচ্ছেন মেসি, যেন বিশ্বকাপটাই মেসিময়। মেসিতেই সকলের ভালোবাসা, মেসিতেই চাওয়া-পাওয়া।

(ঢাকাটাইমস/১৯ডিসেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

খেলাধুলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

খেলাধুলা এর সর্বশেষ

লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগের দল কিনলেন দুই বাংলাদেশি

ধোনি নামতেই গ্যালারিতে ‘কান ফাটানো’ শোরগোল, ঘড়িতে ‘নয়েজ এলার্ট’

আইপিএলে একই ম্যাচে জরিমানা গুনলেন দুই অধিনায়কই

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১৬০০ মিটার দৌড়: অনুপস্থিত পাঁচ ক্রিকেটার

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফিরে স্মৃতিকাতর শাহরিয়ার নাফিস, আছে আক্ষেপও

রোনালদো নেই, সাদিও মানের জোড়া গোলে আল নাসরের জয়

সেমিফাইনালের আগে নিষেধাজ্ঞায় এমিলিয়ানো মার্টিনেজ

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১৬০০ মিটার দৌড়ালেন মাহমুদউল্লাহ-শান্তরা

‘অনেক বেশি ক্ষুধার্ত ছিলাম, পেট ভরেনি এখনও’- ৫ উইকেট নিয়ে নাসুম

দুই হলুদ কার্ড পাওয়ার পরও মাঠ ছাড়েননি মার্টিনেজ, ফুটবল আইন কি বলে?

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :