‘মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না’

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:২৪

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলন থেকে ফিরে আজ এ লেখাটা লিখছি। গত কয়েকদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর একটি কথা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”তে ১৯৫৪ সালের নির্বচনী প্রচারাভিযানে গ্রামের এক দরিদ্র বৃদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথন শেষে লিখে গেছেন ‘মানুষের ধোঁকা আমি দিতে পারবো না’ (পৃষ্ঠা ২৫৬)।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘‘আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানে পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসাবে হাজির করত এবং না নিলে রাগ করত।...আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে একটা পার্টি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরো কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ঠ, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।’ সে টাকা সে নিল না। আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।’ নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারবো না।’’

আজকের দিনে অনেকেরই অভিমত, বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ-নেতা আজকের যুগে দুর্লভ! আর ভালো মানুষের সংখ্যা নাকি দিন দিন কমে যাচ্ছে, যারা কিনা নেতাকে ভালোবাসতেন অন্তরের গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে, আর নেতারা ভাবতেন জনগণের দুর্ভোগ/কষ্ট নিয়ে। নাটকে/সমাজে আজ নেতা মানে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভোটটা নিয়ে নিজের আখেরাত গোছানো এক সুবিধাবাদী চরিত্র! আর ওই নাটকে কর্মী মানে চাটুকার! আর দুজনের মাঝে এক অদ্ভুত মিল: জনগণকে উভয়েই সোনার ডিমের রাজঁহাস মনে করেন। ভুক্তভোগীদের অভিমত, সালামের সঙ্গে সালামী দিলে কার্যকরী তদবির/সুপারিশ করা হয়!

তবে গুজব আর প্রচারণার জোরে কোনটি সত্যি আর কোনটি মিথ্যা সেটা এখনকার দিনে বোঝা খুবই দুঃস্কর হয়ে গেছে। নেতাদের সত্যি কথা তাই মনে হয় মিথ্যা আশ্বাস, আর মিথ্যা প্রতারণামূলক উক্তিগুলো- এমন শক্তিশালী যে সেগুলো দিয়ে কিছু মানুষ নামের অমানুষ, সুন্দরভাবে সমাজের নিরীহ মানুষদেরকে ধোঁকা দেয়! কি বিচিত্র মানব চরিত্র!

এবারও সম্মেলনে গিয়ে আমি সেই মানুষগুলোকে খুঁজেছি, যাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধু "মানুষের ধোঁকা আমি দিতে পারবো না।" কথাটি লিখে রেখেছিলেন আত্মজীবনীতে। ২০১৯ সালে যে সম্মেলনটি হয়েছিল, সেই সম্মেলনে যাবার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম ভিআইপি হিসেবে। ভিআইপিদের আলাদা গেট, সংরক্ষিত আসন থাকে। আমার এক সহকর্মী কোনো কার্ড পায় নি। কিন্তু সম্মেলনে যেতে চান। সানন্দে আমি তাকে দিয়ে দিয়েছিলাম আমার কার্ডটি। চেষ্টা করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সৈনিক হতে।

এবারও আমি আমজনতার সঙ্গে থাকতে চাই। সেজন্য এবার কাউন্সিলর কার্ডটি পেয়েও আমজনতার সঙ্গে টিএসসির সামনের গেট দিয়ে লম্বা লাইন দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম। আবার তাদের সঙ্গেই ভীড় ঠেলে বের হলাম। তবে আগামীতে হয়তো এভাবে আর পারবো কিনা জানিনা। গেটে যে চাপ সেটাকে সামাল দিয়ে চলার শক্তি এখন নেই। আজকের গেটের জনতার চাপ মনে করিয়ে দিল কিশোর বয়সে সিনেমার টিকিট কাটবার স্মৃতিগুলোকে।

সম্মেলনে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে মুখ দেখে কিংবা আলাপন শুনে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম কেন তারা এতো কষ্ট করে সেই সন্দীপ, কুয়াকাটা, পঞ্চগড় কিংবা বান্দরবন থেকে এসেছে। ভেতরে প্রবেশ করে সবশেষ চেয়ারটিতে বসলাম। কিছুক্ষন পর ভাবলাম আরও পেছনে যাই। নিরিবিলি যেখানে।

কিন্তু সময় পেরিয়ে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো পুরো উদ্যান। যে নিরিবিলি পরিবেশ চাইছিলাম তা চলে গেলো নিমিষে। সামনে পেছনে সিগারেটের ধোঁয়া। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে লোকেরা সিগারেটে ধরালো! কারণ গেটে যখন চেক করা হচ্ছিলো তখন সিগারেটে লাইটার বা ম্যাচ আনতে দেয়া হয়নি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। সিগারেটের ধোঁয়া থেকে বাঁচতে গিয়ে আরও একটু পেছনে গেলাম। পেছনে গিয়ে হতবাকও হলাম! সেখানে চলছে সিগারেটের বাণিজ্য! সিকিউরিটি সেগুলো দেখেও দেখছেন না! এই আমাদের দ্বৈত-চরিত্র! আমরা ধোঁকা দিচ্ছি আমাদের জনগণকে—নেতৃবৃন্দকে ! বঙ্গবন্ধু আমরা আপনাকে এইভাবেই ভালোবাসার নামে কষ্ট দেই!

ওই হকারদের কথাই বা কি বলি, আমাদের মতো শিক্ষিত মানুষেরা বড্ড বেশি সুবিধাবাদী। আদর্শর কথা বলি, কিন্তু কাজের বেলায় নেই। ক্ষমতা পেলে নগদায়ন করতে ভুল করি না! মানুষের মুখ দেখে নাকি মানুষ চেনা যায়। তবে মুখ দেখে কে যে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সৈনিক সেটা বোঝা কঠিন। তবুও তাদের অনেকের মুখে স্বচ্ছতা আছে। একজন বলছিলো সে নেত্রীর মুখখানা খালি চোখে দেখার বাসনা নিয়ে এসেছে। খুব ভালো লাগলো নেত্রীর প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে। তারা নেত্রীর মুখে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পায় বলে এতো কষ্ট করে আসে!

অনেকেই মনে করেন, আমরা নাকি অহর্নিশ ধোঁকা খাচ্ছি, মায়াজালে আবৃত এই পৃথিবীতে। যাদেরকে আমরা বুদ্ধিজীবী বলি তারাও নাকি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সেই প্লেটোর দার্শনিক বুদ্ধিজীবী আজ মেলা ভার, যারা অজ্ঞতা বা অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত। আমরা যে চাল, ডাল, মাছ, গোশত, তরিতরকারি খাই, সেগুলোর অধিকাংশ হাইব্রিড। কদিন আগে বেগুন কিনতে গিয়ে দেখি পোকা ওয়ালা বেগুন। খুবই খুশি হয়ে দুই কেজি বেগুন কিনে ফেললাম। পরে মনে হলো ঠকে গেলাম বুঝি! হয়তো বিশ্বাস অর্জনের জন্য দুই চারটা পোকা ওয়ালা বেগুন রেখে দিয়েছে বিক্রেতা!

এখন শহরে অনেক নামিদামি দোকান। কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই! অথচ আশির দশকেও আমাদের মাঝে বিশ্বাস জিনিসটা ছিল। তখন খুব কমই ধোঁকাবাজি চলতো। এখন কোথাও আমাদের বিশ্বাস নেই। কেউ সত্যি কথা বললেও সন্দেহ করি! কি এক নির্মম পরিবেশ আমাদের সমাজে বিরাজ করছে! মানুষ তাই একটু টাকা হলে বিদেশ চলে যায় ধোঁকাবাজি থেকে বাঁচতে।

যারা আমাদের দেশপ্রেম শেখাতেন তারা এখন বলে ভাগো, যেখানে পার চলে যাও! কি হতভাগা আমরা! ধোঁকা, ধোঁকাবাজি, ধোঁকাবাজে কি তবে আমার দেশটা ভরে গেছে? মানবতার কথা ভুলে আমরা সুবিধার কথা ভাবি! ন্যায়ের কথা বলে দুর্নীতির পথে চলি; আবার যারা বেশি নীতির কথা বলেন তারাই জাতিকে ধোঁকা দেন। গালভরা মুক্তিযোদ্ধার কথা বলি, কৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাই রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরকে। আর রেমিটেন্স পাচার করি চড়া দামে সস্তা জিনিস বিক্রি করে!

নেতারা কয়েকজন বসে আসছেন বাইরে আর বলছিলেন আপনারা ভেতরে গিয়ে ভাষণ শুনুন! বঙ্গবন্ধু আমরা আপনাকে সামনে রেখে যা করছি তাতে জাতি লজ্জিত! আমাদের বড়ো বড়ো অধ্যাপকেরা নিজেরা ক্লাস ঠিকমতো নেন না, গবেষণা করেন না আর বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার ফ্যাক্টরি বানিয়ে ফেলেন নীলক্ষেত, কচুক্ষেত আর সদরঘাটের বাংলা বাজার থেকে কেনা গবেষণা দিয়ে!

আজকের লেখা শেষ করতে চাই এক ছাত্র ও এক অধ্যাপকের কথপোকথন দিয়ে। জনৈক ছাত্র তার শিক্ষককে প্রশ্ন করে– স্যার, আপনিতো রিসার্চ মেথডোলোজি পড়ান তা আপনার কাছে কেউই এমফিল /পিএইচডি করে না কেন? স্যার,আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো যেখানে অপশনাল কোর্স আছে সেখানেও ছাত্ররা আপনার কোর্স পছন্দ/ নির্বাচন করেনা। কিন্তু কেন? শিক্ষক ছাত্রের কাছে জানতে চায়: বলতো কেন? ছাত্রটি সহাস্যে উত্তর দেয়: স্যার আপনিতো নম্বর কম দেন তাই কেউ আপনার কোর্স নিতে চায় না! শিক্ষক ছাত্রের উত্তরে কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। অতঃপর নীরবতা ভেঙ্গে শিক্ষক ছাত্রটির কাছে জানতে চান: আর গবেষণা করতে আসে না কেন? স্যার সেটা আপনি ভালো বোঝেন। ওই যে plagiarism! অবসরে অধ্যাপক ভাবেন, আর বিড়বিড় করে বঙ্গবন্ধুর মতো ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন: বাপুরা তোমাদের ‘ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :