স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যত্নে রাখুন উপকারী ব্যাকটেরিয়া

প্রকাশ | ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৫৯ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:১২

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীব। ব্যাকটেরিয়া হল কোষ প্রাচীর বিশিষ্ট এককোষী, প্রাককেন্দ্রিক অণুজীব যা সাধারণত ক্লোরোফিলবিহীন এবং প্রধানত দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় বংশ বৃদ্ধি করে। ৩৬০ কোটি বছর পূর্বে আর্কিওজয়িক যুগে আদিকোষী জীবের উৎপত্তি ঘটেছিল। প্রচন্ড ঠান্ডা -১৭ ডিগ্রী থেকে ৮০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে ব্যাকটেরিয়া।

অনেকেই বলেন, ব্যাকটেরিয়ামাত্রই ভিলেন এবং মারাত্মক সংক্রমণ সৃষ্টি করে এবং তাদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো। এ ধারণাটি মোটেও ঠিক নয়। যেমন শরীরে বাসা বাঁধা কমেনসাল ব্যাকটেরিয়াগুলো আসলে উপকারী ব্যাকটেরিয়া। কেউ আমাদের মরা ত্বক-কোষ পরিষ্কার করছে, কেউ দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণাকে দূর করছে, কেউ পেটের মধ্যে খাবার হজমে সাহায্য করছে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর বলেছিলেন, কমেনসাল ছাড়া জগতে কোনো প্রাণীই নেই। আর একালের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো ছাড়া আমাদের ইমিউন সিস্টেম ঠিকমতো কাজই করতে পারবে না। আপনার অন্ত্রের মধ্যেই এই জীবাণু প্রচুর পরিমাণে রয়েছে যারা ‘উপকারি’!

আমাদের পাচনতন্ত্রের (গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল ট্র্যাক্ট) মধ্যেই অসংখ্য আণুবীক্ষণিক জীব বসতি গেড়ে আছে যারা একত্রে ‘গাট মাইক্রোবায়োম’ নামে এক ক্ষুদ্র-বাস্তুতন্ত্র (মাইক্রো-ইকোসিস্টেম) রচনা করে। এই সমস্ত ব্যাকটেরিয়া পাচনে সাহায্য করে এমনকি আমাদের সুখানুভুতি এবং অন্যান্য মানসিক ক্রিয়াকলাপেও এদের অবদান আছে! এই ক্ষুদ্র-বাস্তুতন্ত্রের আদি বাসিন্দা হল বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম শ্রেণীর ব্যাকটেরিয়া যা মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত থাকে। আমরা যত বেড়ে উঠি, আমাদের খাদ্যের মাধ্যমে এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে আমাদের অন্ত্রে রকমারি ব্যাকটেরিয়ার সম্ভার বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বিজ্ঞানীরা সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কোষ্ঠ (বিষ্ঠা) হতে প্রায় ৪০০ রকমেরও বেশি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করেছেন, যার মধ্যে বেশির ভাগই অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়া যা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে বৃদ্ধি পায়। আমাদের পাচন তন্ত্রের উপরের অংশে, অর্থাৎ পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্রের সমন্বিত অংশ, যে আন্ত্রিক ক্ষরণ হয় তাতে প্রতি মিলিলিটারে প্রায় দশ হাজার আণুবীক্ষণিক জীব থাকে।

আমাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি ব্যাকটেরিয়া কোথায় থাকে জানেন কী? আমাদের মুখগহ্বরে! অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া আমাদের জিহ্বার পিছনে বসবাস করে এবং প্রত্যেকবার খাবারের সঙ্গে অন্ত্রে প্রবেশ করে। এমনকি বৃহদন্ত্রের মধ্যেও এই জীবাণুগুলি বহুল পরিমাণে থাকে-এক গ্রাম মনুষ্যকোষ্ঠের মধ্যে এর পরিমাণ প্রায় ১০০০০ কোটি! অন্ত্রের জীবাণুগুলি আমাদের অন্ত্রের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকার ফলে রোগপ্রদানকারি ব্যাকটেরিয়া সহজে আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে না। বহিরাগত জীবাণুর সংক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে এই আভ্যন্তরীণ জীবাণুকুল প্রধান অন্তরায় হিসাবে কাজ করে।

অন্ত্রের এই জীবাণুগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হলে বিভিন্ন রোগ হতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম হল ব্যাকটেরিয়াল ডায়েরিয়া। আমাদের যকৃত দ্বারা উত্পাদিত পিত্তরসে জীবাণুনাশক ক্ষমতা আছে এবং এই রস এইসমস্ত জীবাণু নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। শরীরের মধ্যের এই ‘উপকারি’ জীবাণুতন্ত্র ব্যাকটেরিওসিন নামক জীবাণুনাশক এবং ফ্যাটি অ্যাসিড ক্ষরণ করে, যেগুলো এদের সংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে ও শরীরের মধ্যে বহিরাগত রোগপ্রদানকারি ব্যাকটেরিয়ার সঞ্চারণ প্রতিরোধ করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এও দেখা গিয়েছে যে অন্ত্রের এই ‘উপকারি’ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা এবং প্রজাতির রকমভেদ স্থূলতা এবং হৃৎপিন্ড ও রক্তসংবাহনপ্রণালীজনিত (কার্ডিওভাসক্যুলার) রোগগুলির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমাদের শরীরে এই পরজীবীগুলো কোত্থেকে এল? জন্মের আগে আমরা যখন মাতৃগর্ভে থাকি, তখন অ্যামনিওটিক ফ্লুইড আর প্লাসেন্টা বাইরের পরিবেশ থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখে, কোনো জীবাণু প্রবেশ করতে দেয় না। জন্মের পরপরই পরিবেশের নানা জীবাণু ও পরজীবীদের সঙ্গে আমাদের আলাপ-পরিচয় হয়। এরা কেউ কেউ শরীরে প্রবেশ করে, কেউ ত্বকের ওপর, চুল বা ভ্রুর মধ্যে এসে গড়াগড়ি খায়। কেউ কেউ ঢুকে পড়ে নাক–মুখ দিয়ে শরীরের ভেতর। এভাবেই ওদের সঙ্গে শুরু হয় সখ্য ও বন্ধুত্ব।

তারপর ধীরে ধীরে তারা মানবশরীরের সঙ্গে একটা দীর্ঘমেয়াদি, লাগসই ও নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলে। এ সম্পর্কটি পারস্পরিক নির্ভরতার। তারা বেঁচে থাকার রসদ এই শরীর থেকেই গ্রহণ করে, বিনিময়ে এর কোনো ক্ষতি করে না; বরং উপকার করারই চেষ্টা করে। এ জন্য এদের আরেক নাম মিউচুয়াল অরগানিজম, মানে এদের সঙ্গে মানুষের একটা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা বোঝাপড়া হয়ে যায়।

তবে রক্ত, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বা সলিড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন যকৃৎ বা কিডনি ইত্যাদি কিন্তু জীবাণুমুক্ত। কোনোভাবে এসব ব্যাকটেরিয়া ওই সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঢুকে পড়লে সমস্যা হতে পারে। এ জন্য এসব জীবাণুকে বলা হয় অপরচুনিস্টিক মাইক্রো অরগানিজম বা সুবিধাবাদী জীবাণু। এরা সুযোগের অভাবে ভালো মানুষ, কিন্তু সুযোগ পেলেই, যেমন—রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।

এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে আমরা যে পুষি, তার কিছু উপকারিতাও আছে। যেমন আমাদের সারা দেহের ত্বকে আছে মিলিয়ন মিলিয়ন জীবাণু, বিশেষ করে শরীরের ভাঁজগুলোয়। বাইরের ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে এরাই। ডেমোডেক্স ব্রেভিস ও ডেমোনেক্স ফলিকুলোরাম এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এরা মরা ত্বককোষ, ঘাম ও তৈলাক্ত পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে। ওদিকে বাইরের কোনো ক্ষতিকর জীবাণু এলে রুখে দাঁড়ায়।

চোখের পানিতে আছে করাইনো ব্যাকটেরিয়া, এরা কর্নিয়াকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে যায়। পরিপাকতন্ত্রে আছে ই কোলাই, এরা খাদ্যকণা ভেঙে ভিটামিন কে তৈরিতে সাহায্য করে। ল্যাকটোব্যাসিলাস আছে বলেই শিশু জন্মের পর এত সহজে দুধ হজম করতে পারে। আবার পরিপাকতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যাসিড ও টক্সিন তৈরি করে অন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধিকে বাধা দেয়, এভাবে আমাদের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এ কারণেই ক্ষমতাধর অ্যান্টিবায়োটিক বেশি ব্যবহার করে অন্ত্রের সব কমেনসালকে মেরে ফেলার পর অন্ত্রে বাইরের জীবাণু দিয়ে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটে যেতে পারে।

চিকিত্সাবিজ্ঞানে এই সমস্যার একটা বিশেষ নামও আছে—সিউডোমেমব্রেনাস কলাইটিস। ঠিক একইভাবে জীবাণুরোধী ও অ্যান্টিসেপটিক সাবান বেশি ব্যবহার করলে ত্বকের উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো যায় মরে, ফলে ক্ষতিকর সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আজকাল তাই বিজ্ঞানীরা শরীরের উপকারী জীবাণুগুলোকে ডিস্টার্ব না করে এদের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতেই বেশি আগ্রহ পোষণ করছেন।

বিখ্যাত হাইজিন হাইপোথিসিস বলছে যে, শিশুরা জন্মের পর খুব বেশি জীবাণুমুক্ত পরিবেশে বড় হয় এবং পরিবেশের জীবাণু বা পরজীবীদের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় না-পরবর্তী জীবনে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি এই হাইপোথিসিসে এ ধরনের শিশুদের পরবর্তী সময়ে হাঁপানি, অ্যালার্জি, টাইপ ১ ডায়াবেটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরসিস ও লিমফোব্লাসটিক লিউকেমিয়ায় বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। ২০০৩ সালে এই থিওরির প্রবক্তা গ্রাহাম রুক তাই এই জীবাণুদের নাম দেন ‘ওল্ড ফ্রেন্ডস’ বা মানবজাতির পুরোনো বন্ধু। তিনি বলেন, মানবশরীরে ভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাস বেশি পুরোনো নয়, মাত্র ১০ হাজার বছরের। কেননা এর আগে আদিম মানুষ পরিবেশ ও বনজঙ্গলের সঙ্গে এমন এক মিথস্ক্রিয়ায় বসবাস করত যে তাদের সংক্রমণজনিত রোগ হতো না বললেই চলে। এই থিওরি এটাও প্রমাণ করেছে যে যেসব শিশু বড় পরিবার, অধিক সংখ্যক মানুষ ও প্রাণীদের সাহচর্যে, যেমন—গ্রাম বা ফার্মের কাছাকাছি বড় হয়, তাদের অ্যালার্জি ও অটোইমিউন রোগের হার কম।

আমাদের শরীরের মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া আমাদের বন্ধু ও সহচর। অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিসেপটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ‘হাইজিন সেন্স’ মানুষকে পরিবেশের স্বাভাবিক ইকোসিস্টেম থেকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে কি না, এটাও ভাবার বিষয়। সম্প্রতি হিউম্যান মাইক্রোবিয়ম প্রজেক্ট তাদের গবেষণার শিরোনাম দিয়েছে-ডিয়ার ব্যাকটেরিয়া, আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক!

উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের সংখ্যা ও বৈচিত্র বাড়লে আমরা ভাল থাকি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। পেটের গোলমাল কম হয়। সবচেয়ে বড় কথা, ওজন বশে থাকে। এখন অতিরিক্ত ওজন ঝরিয়ে ফেলতে অনেকেই খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বিধি-নিষেধ মেনে চলেন। কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় হাজার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ওজন কমে না কিছুতেই। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, পেটের সেই উপকারী জীবাণুগুলোর সংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হলে হাজার চেষ্টা করলেও স্বাস্থ্যের হাল ফিরবে না।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত একটি কলেজের কয়েক জন চিকিৎসকের করা একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, পেটে থাকা কিছু ‘ফিলমেন্টাস ব্যাক্টেরিয়া’ ধ্বংস হয় অতিরিক্ত চিনি খেলে। কাজেই অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া কমিয়ে ফেলুন। ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার বন্ধ করে খান ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার। অর্থাৎ চিনি, মিষ্টি, লুচি-পরোটা-চিপস-কাটলেট, প্যাকেটজাত খাবার খাওয়া বন্ধ করুন। চিজ-ডিমের কুসুম-তেল-ঘি-মাখনে রাশ টানুন। তার বদলে খান শাক-সবজি-ফল, বাদাম, বিভিন্ন বীজ।

ঘুমের অনিয়ম করবেন না। মাত্র দু’সপ্তাহ ঘুম অপর্যাপ্ত হলেই অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়াদের ভারসাম্যে বড় রকমের পরিবর্তন আসতে পারে। তা ছাড়া অনিদ্রা শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বিগড়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় মানসিক চাপ, ডায়াবিটিস ও স্থূলতার ঝুঁকি।

কথায় কথায় অ্যান্টিবায়োটিক খেলে অন্ত্রে ভাল-মন্দ সব ব্যাকটেরিয়াই মরে দলে দলে। অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই মুড়ি-মুড়কির মতোই এই ওষুধ খান। এতে অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াদেরও ক্ষতি হয়। প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে শুরু করে। হজমের সমস্যাও প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে ওজনের কমানো বা বাড়ানো, দুই ক্ষেত্রেই সমস্যা হতে পারে।

অন্ত্রে সরাসরি ভাল ব্যাকটেরিয়ার জোগান দিতে টক দই খান নিয়ম করে। তা ছাড়াও ইয়োগার্ট, কেফির নামের এক ধরনের ঘোল, কম্বুচা নামের এক ধরনের গেঁজানো সবুজ পানীয় খেতে পারেন। ল্যাকটিক অ্যাসিডে গেঁজানো বাঁধাকপিও খান অনেকে। একে সটেক্র্যাট বলে। তবে সব খাবার তো সবার সহ্য হয় না, তাই যে কোনও খাবার রোজ খাওয়ার আগে এক বার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিন।

ঢাকাটাইমস/০১ জানুয়ারি/আরজেড)