রাজার বিদায়ে অশ্রু ঝরছে ফুটবল বিশ্বের
প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৫
৮২ বছর বয়স, ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। তাঁর সাথে কখনোই দেখা হয়নি, বাংলাদেশ থেকে ষোল হাজার কিমি-এর পথ। তাঁর দেশেও যাওয়া হয়নি আমার। অথচ সে মানুষটির জন্য আজ ভোর থেকেই বিরাট শূন্যতা অনুভব করছি। নিঃসঙ্গতা ভর করছে আমার, দামী মূল্যবান কি যেন হারিয়ে ফেলেছি। একটা হাহাকার সর্বত্র, চোখও অশ্রু সজল হয়ে উঠছে আমার বারবার।
৯০ এর দশকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কালো মানিক শিরোনাম একটি লেখা পাঠ্য হিসেবে পেয়েছিলাম। নবম-দশম শ্রেণীতেও ফুটবলের রাজা নামেও একটা গল্প ছিল। ব্রাজিলের ছোট্ট শহর ট্রেস কারাকোস, ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর সাও পাওলো শহরে তার জন্ম। ওই সময় সেই এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার মান ভয়ঙ্কর ছিল। দরিদ্র পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে অভাব অনটনটা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে হয়েছে ছোটবেলা থেকে। আর তাই অভাব মেটাতে কৈশোর থেকেই কাজ শুরু করেন চায়ের দোকানে। রেলস্টেশনে ঝাড়ু দেওয়া কিংবা জুতা পরিষ্কার করার কাজও করতে হয়েছে তাকে।
তার বয়স যখন দশ বছর; মারাকানায় ট্রাজেডিতে লণ্ডভণ্ড ব্রাজিল। নিজের দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের খুব কাছে এসেও উরুগুয়ের শেষ মুহূর্তের গোলেই স্বপ্নভঙ্গ হয় ব্রাজিলের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বজয়। কোটি কোটি ব্রাজিলিয়ানদের মতো সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিল তার বাবা; কেদেছিলেন ছোট্ট এ ছেলেটিও। সেদিন সেই বাবাকে জড়িয়ে বলেছিলেন, ‘কেঁদো না! একদিন এই বিশ্বকাপটা তোমায় এনে দিব। আমার দেশকে এনে দিব।’
এরপর ইতিহাস! পুরো দুনিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন এক কালোমানিকের আধিপত্য! খালি পায়ে ফুটবল মাঠে পদচারণায় শুরু, বল পায়ে জাদুকরী ছোঁয়ায় গ্রাম-শহর ছাড়িয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বুকে আলো ছড়িয়ে কেবল ফুটবলেই নয়, ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠা এক নাম পেলে। অবিশ্বাস্য সব স্কিল আর মুখে প্রশান্তি বিজয়ীর হাসি, তিনি ফুটবলকে করেছেন ক্রীড়াবিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ফুটবল-পাগল প্রতিটি সাধারণ মানুষ তো বটেই, তার মোহনীয় নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছেন পোপ, বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, হলিউড তারকা থেকে শুরু করে সবাই। শুরুতে ফুটবল জাদুকর, পরে ফুটবল দূত হিসেবে প্রায় সাত দশকের ক্যারিয়ারে ফুটবলের মাঝেই ছিলেন তিনি। ব্রাজিলের ক্রীড়া মন্ত্রিসভার সদস্যও হয়েছিলেন।
ফুটবলে পেলে যে দক্ষতা পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন সেটা মানুষের কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল খেলাধুলার বাইরের জগতেও। ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবলের এই কিংবদন্তি। সেসময় শুধু পেলেকে দেখার জন্য ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল গৃহযুদ্ধে জড়িত দলগুলো। ফুটবলের বাইরে টিভির পর্দাতেও ছিলেন পেলে। সিনেমা ও টেলিভিশন ধারাবাহিকেও কাজ করেছেন তিনি। হলিউড মুভিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। মানুষ পেলেও যেন ছিলেন সবার আপন। অভাব অনটনে বড় হওয়া পেলে খেলোয়াড় থাকা অবস্থায়ই অসহায় মানুষ এবং দরিদ্র শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন।
ফুটবলের বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো আজ!
ঝরে গেল ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র!
জীবনে কত ম্যাচ জিতেছেন, কত হেরে যাওয়ার ম্যাচে শেষ সময়ে গোল করে ফল পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু ক্যানসারের সঙ্গে এই ‘ম্যাচে’ লড়াই করেও শেষ পর্যন্ত হার মানলেন। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওপারে পাড়ি দিলেন আমার কৈশোরের নায়ক, ফুটবলের রাজা। সারা বিশ্বে প্রচুর সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা; তিনি সবসময়ই বলতেন,
"আমাদের সবার সকল সমস্যার সমাধান এই ভালোবাসা।”
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা