মুজিবনগর সরকার যুদ্ধজয়ের পর যেভাবে বরণ করেছিল বঙ্গবন্ধুকে

প্রকাশ | ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৭ | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৩

সোহেল সানি

“রক্ত দিয়েই যদি স্বাধীনতার মূল্য নিরূপণ করা হয় তাহলে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এমন স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর কয়টা দেশ-জাতি পেরেছে-আমার জানা নেই, যার মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।”

বৃটেনের বিখ্যাত সংবাদপত্র New Statesmen এর সম্পাদক কিংসলি মার্টিন তাঁর স্বনামে প্রকাশিত এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে উপর্যুক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। অথচ তখনো রমনার রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পূর্বদিগন্তে বিজয়-নিশান উড়িয়ে "স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ" অভ্যুদয় ঘটেনি। ওই রেসকোর্স ময়দান থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তির ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর।”

ইতিহাসের কী অপূর্ব মিশেল! সেই রেসকোর্স ময়দানেই  জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর নব্বই হাজার সৈন্যের নিঃসহায় আত্মসমর্পণের দৃশ্য মঞ্চস্থ হলো। কিন্তু যৌথবাহিনীর কমান্ড ভারতীয় জেনারেল জগতসিং অরোরার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিজয় হলেও বাঙালির সার্বিক মুক্তি অপূর্ণ থেকে যায় জাতির পিতা তখনো পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির কারাগারে বন্দিদশা অবস্থায় থেকে যাওয়ায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ঘরে-বাইরে তখনো উৎকন্ঠা আর নানা গুজব। কেননা ৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেওয়া ফাঁসির রায় কার্যকর করার দিন হিসেবে ৪ জানুয়ারি নির্দিষ্ট ছিল। এমনকি কবর খোঁড়ার খবরও ফাঁস হয়ে পড়েছিল।

মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও মুজিব বাহিনীর সৃষ্ট দ্বন্দ্ব উৎকন্ঠা ও গুজবকে আরো প্রকট করে তুলছিল। এ করণে মুজিব বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে জনসভা করারও ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন- এমন গুজবও রটে গিয়েছিল চারদিকে। এরকম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমেদ ছুটে যান বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে, ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের একটি বাড়িতে। তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে সরকারের সার্বিক তৎপরতা সম্পর্কে বেগম মুজিবকে অবহিত করেন।

তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করতে থাকেন। কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা শেখ মুজিবের যদি কিছু হয়ে যায়, তবে ফলাফল ভয়াবহ হবে বলেও হুমকি দেয়। এমন এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে ১৯৭২ এর ৩ জানুয়ারি করাচির জনসভায় পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের  রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।

১৬ ডিসেম্বর বিজয় হলে ২২ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) এসে ওঠেন। পদচ্যুত পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ গিয়ে ওঠেন তার পুরান ঢাকার আগামসি লেনের বাড়িতে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে খন্দকার মোশতাকের স্থলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেন আব্দুস সামাদ আজাদকে। মোশতাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে কনফেডারেশন গঠনের প্রয়াস চালানোর। আগেই জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতারূপে মোশতাককে বাদ দিয়ে লন্ডনে দায়িত্বরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পাঠানো হয়েছিল। তারপরও আইনমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে বলা হলে অগ্রাহ্য করেন মোশতাক। তিনি অসুস্থতার ভান করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।

যাহোক ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে বিবিসি খবর দেয় যে, বঙ্গবন্ধু একটি চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনের পথে রয়েছেন। সেই খবরে মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বিবিসি দ্বিতীয় খবরে বলে, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি সকাল সাড়ে ৬টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। সকাল দশটায় দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বিরল অভিবাদন জানিয়েছেন। ওদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বাসায় গিয়ে বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে ফেরার সময়সূচি জানান। বঙ্গবন্ধু  ৯ জানুয়ারি রাতে লন্ডন ত্যাগ করে পরদিন দিল্লিতে পৌঁছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। ভারতীয় একটি বিমানে কলকাতায় এক ঘণ্টা যাত্রা বিরতি করে বিকাল চারটার দিকে ঢাকা পৌঁছবেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে বেগম মুজিব প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে অনুরোধ করে বলেন, দিল্লিতে বিমান পরিবর্তন করলে বৃটেন মনঃক্ষুন্ন হতে পারে। তাঁর ব্রিটিশ বিমানেই ঢাকা আসা উচিত। ততক্ষণে তাজউদ্দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডি পি ধরকে ফোন করে বেগম মুজিবের পরামর্শ জানিয়ে দেন। সে অনুযায়ী ১০ জানুয়ারি দুপুরের দিকে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান “কমেট” দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রিসভা বিশাল অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই লাখ লাখ ভারতীয়র উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “এক বিরাট সংকল্প নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে-বাংলাদেশে। সামনে যে পথ আমরা রচনা করবো, তা হবে শান্তির এবং প্রগতির পথ। কারো জন্যে কোনো ঘৃণা বুকে নিয়ে আমি ফিরছি না। মিথ্যার ওপরে সত্যের জয়, অশুচিতার ওপরে শুচিতার জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং সর্বোপরি অশুভ ও অসত্যের ওপরে সর্বজনীন সত্যের বিজয়ের প্রেক্ষাপটে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের দেশে-রক্তস্নাত ওপর শুচিতায় উদ্ভাসিত স্বাধীন বাংলাদেশে। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি “সাদাকমেট” বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রিয় নেতাকে অভিবাদন জানাতে মন্তিসভার সদস্যরা আগে থেকেই উন্মুখ। দাঁড়িয়ে ছিলেন মুজিববাহিনীর চার অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মিলন,  সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং মুক্তিযুদ্ধের খলিফাখ্যাত চার ছাত্রলীগ তথা স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী, পদচ্যুত মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনও বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন। এরপর একটি ডজ ট্রাক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাত্রা করে রেসকোর্স ময়দান অভিমুখে। ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রিত ট্রাকটিতে গাদাগাদি করে দন্ডায়মান ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। বিকাল তিনটায় অবতরণ করেছিল বিমানটি। ছাত্রলীগ নেতারা ব্যুহের মতো করে মঞ্চের কাছে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুকে। লাখ লাখ মানুষের উপচেপড়া ভিড় ঢেলে যখন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উপবিষ্ট, তখন জয়বাংলার গগনবিদারি স্লেগানে মুখরিত ময়দানের জনস্রোত। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের কন্ঠ মাইকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে গর্জে উঠে শোনায় শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনী বার্তা। উল্লেখ্য, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইযুব খানের পতনের পর  ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ ২৩ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধি প্রদান করে এক জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে। ছাত্রজনতা করতালির মাধ্যমে মুহুর্মুহু স্লোগান দিয়ে অভিষিক্ত করে। তোফায়েল আহমেদ ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে সেই বঙ্গবন্ধু অভিধায়ই শেখ মুজিবকে অভিষিক্ত করে বলেন, ‘ভাইসব’ বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধুর এবং আমাদের নিরাপত্তার জন্যে দয়া করে সবাই বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আশপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনির হাত যে কোনো জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে। কড়া নজর রাখবেন। তোফায়েল আহমেদের এ বক্তৃতার মধ্যেই চোখের পলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভামঞ্চে এসে হাজির। তিনি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিথর নীরব হয়ে থাকলেন। ময়দানে উত্তেজনার উদ্বেল আনন্দ ধ্বনি। বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বললেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আমি বলেছিলাম, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন।... ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালির প্রাণ থাকতে এ স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবো না।”

পাকিস্তানি জেলখানায় নিজের বন্দিদশার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, "আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, আমার সেলের পাশে আমার কবর খোঁড়া হয়েছিল, আমি মুসলমান, আমি জানি মুসলমান একবারই মরে, তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতিস্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময়ও আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।"

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে জাতির পিতা  মুজিব বলেন, "আমি যখন চাইবো ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য বাহিনী তখনই প্রত্যাহার করে নেবে।"

ভাষণের একপর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি” উদ্ধৃতি করে বলেন, "এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পুড়ে সোনার মানুষ হয়ে উঠেছে। আপনাদের মুজিব ভাই আহবান জানিয়ে ছিলেন আর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। বাঙালি বীরের জাতি। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের পদানত করতে পারবে না। বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করে বলেছেন, সম্ভব হলে আমি যেন লুস ফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। তাকে বলেছি, আমার জনসাধারণের নিকট আমি ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। এখন আমি বলতে চাই, ভুট্টো সাহেব আপনারা সুখে শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ সেই স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায় তাহলে এই স্বাধীনতা রক্ষার করার জন্য শেখ মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।"

বঙ্গবন্ধু জনসভা শেষ করে সদলবলে ছুটে যান শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজারে। মাজার জিয়ারত করে ওখান থেকে যান শহীদ মিনারে। ততক্ষণে সন্ধ্যা। ওখান থেকে ৩২ নম্বরের সড়কের ধানমন্ডির বাড়িতে। যে বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সেখানে ফেরেন বাবা, মা, ভাইবোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যার মাঝে । এরপর ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলাপে বসেন। মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে বৈরী সম্পর্কের নেপথ্য ঘটনাগুলো শুনেন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনে যান শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে।  এরপর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা জারি করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। উপরাষ্ট্রপতি পদ বিলোপ করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করেন শিল্পমন্ত্রী এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে করেন অর্থমন্ত্রী। আইনমন্ত্রী হিসেবে ড. কামাল হোসেনকে নিযুক্ত করেন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে পাস করা হয় বাংলাদেশের সংবিধান। প্রথম বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর- ১৯৭২ যে সংবিধানের অধীনে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদীয় শাসনামলের।

এভাবেই শুরু হয় জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে "সোনার বাংলা" রূপে গড়ে তোলার ঐতিহাসিক যাত্রা।

 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাসবেত্তা