পুষ্টিগুণে ভরপুর ঐতিহ্যবাহী নলেন গুড়

প্রকাশ | ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫৬ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:১৩

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

হিমালয়ের বাধা পেরিয়ে উত্তরের হাওয়ায় ভর করে শুরু হয়েছে শীতের তীব্র দাপট। শীতকালের অন্যতম প্রাপ্তি হল নলেন গুড়। বাঙালির শীতকাল নলেন গুড় ছাড়া জমে না। রসগোল্লা, পায়েস, সন্দেশ, পিঠে-- সবকিছুতে চাই নলেন গুড়ের ছোঁয়া। এই সময় নলেন গুড়ের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। নলেন গুড়ের তৈরি পিঠে খেলেই মন ভাল হয়ে যায়। তবে মন ভাল রাখার পাশাপাশি নলের গুড় শরীরের খেয়ালও রাখে। স্বাস্থ্যগুণে ভরপুর এই নলেন গুড় অনেক শারীরিক সমস্যার সমাধান করে।

শীতকাল মানেই সর্দি-কাশির প্রকোপ। ঠান্ডা লেগে জ্বর, হাঁচি-কাশি তো লেগেই রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে মাথাব্যথা, চোখ থেকে জল পড়ার মতো সমস্যাও। সুস্থ থাকতে শীতকালে ভরসা রাখতে পারেন নলেন গুড়ের উপর। হঠাৎ মাইগ্রেনের যন্ত্রণা শুরু হলে একটু গরম পানি করে তাতে একটু নলেন গুড় মিশিয়ে খেতে পারেন। উপকার পাবেন।

শীতকালে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়ে। এই সময় পানি পান করার পরিমাণও কমে যায়। ফলে এই ধরনের সমস্যার বাড়বাড়ন্ত হয়। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে নলেন গুড় কিন্তু কাজে আসতে পারে। হজম ক্ষমতা বাড়িয়ে পেট পরিষ্কার রাখে এই গুড়। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে ভরসা রাখতেই পারেন নলেন গুড়ের উপর।

হিমোগ্লোবিনের অভাবে রক্তাল্পতায় অনেকই ভুগছেন। আয়রনের ঘাটতি হলেই মূলত কমতে থাকে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা। নলেন গুড়ে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ আয়রন। রোজ নলেন গুড় খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি মেটে। রক্তাল্পতায় ভুগলে বা শরীরে আয়রনের অভাব হলে শীতকালে প্রতিদিন নলেন গুড় খাওয়া জরুরি।

শীতকালে নানা রকম মরসুমি সংক্রমণের ভয় থাকে। আবার এই মরসুমে প্রতিরোধশক্তি কিছুটা হলেও কমে যায়। এই সময় সুস্থ থাকতে নলেন গুড় খুব উপকারী। এই গুড়ের মধ্যে থাকা জিঙ্ক ও সেলেনিয়াম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সংক্রমণ রোধ করে।

খেজুর গুড়কেই নলেন গুড় বলে অর্থাৎ খেজুর গাছের রস থেকে তৈরি হয় নলেন গুড়। প্রাচীন দক্ষিণ ভারতে নলেন গুড়ের ব্যবহার ছিল বলে মনে করা হয়। কারণ বাংলা-দ্রাবিড় অভিধানে ‘ণরকু’ শব্দের অর্থ হল কাটা বা ছেদন করা। অন্যদিকে বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধান মতে নরুন বা নরশনি মানেও কাটা বা ছেদন করা। এই নরুন হল গ্রামের নাপিতের ক্ষৌর অস্ত্র। খেজুর গাছ থেকে রস বের করতে গুড় প্রস্তুতকারীরা প্রথমে দা অর্থাৎ কাটারি দিয়ে চেঁছে দেয়, তারপর নরুনে ফুটো করে সেখান থেকে একটা বাঁশের ছিলা লাগিয়ে দেওয়া হয় হাঁড়ি পর্যন্ত, এইভাবেই নল দিয়ে রস চুঁইয়ে হাঁড়িতে পড়ে। এর থেকে নলেন গুড় নামের উদ্ভব হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

যাঁরা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন তাদের বলে শিউলি, কথ্য ভাষায় এদের ‘গাছি’-ও বলা হয়ে থাকে। আপনার আমার পাতে নলেন গুড় পৌঁছে দিতে শিউলিদের ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত খাটতে হয়৷

নলেন গুড় তৈরি করার বেশ কয়েকটি ধাপ আছে৷ এর প্রথম ধাপ হল ‘গাছ কাটা’৷ হেমন্তের হিমেল হাওয়া যখন হাল্কা শীতের প্রভাব ফেলতে শুরু করে, সেই সময় থেকেই এই কাজ শুরু করতে হয় শিউলিদের৷ প্রথমে খেজুর গাছের পাতা কেটে পরিষ্কার করতে হয়৷ কেটে ফেলতে হয় অধিকাংশ পাতা৷ এই কাজকে গ্রাম্য ভাষায় বলে ‘গাছ কাটা’৷

‘গাছ কাটা’র পর খেজুর গাছের একেবারে উপরের দিকে পাতার ঠিক নিচের কান্ড কেটে পরিষ্কার করতে হয়৷ ওই অংশ চেঁছে পরিষ্কার করার পর খেজুর গাছের কান্ডের ওই অংশ কিছুটা নরম হয়ে যায়৷ তখন কান্ডের নরম অংশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটা কাঠি বা নল৷ এই নল (বা কাঠি) বেয়ে টুপটুপ করে বেরিয়ে আসে খেজুর রস৷ এই নল যে কোনও কাঠিতে হয় না৷ সাধারণত বাঁশের কঞ্চির একটা অংশ কেটে নিয়ে সেটাকে লম্বালম্বি মাঝখান থেকে চিরে ফেলতে হয়৷ ফলে মাঝখানে একটা সরু পথ তৈরি হয়৷ সেই পথ দিয়েই রস বেরিয়ে আসে।

গাছ কেটে রস বেরনোর পথ তৈরি করার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়৷ শীতের শুরু থেকে গাছে রস আসতে শুরু করে৷ তখন শুরু হয় নলেন গুড় তৈরির দ্বিতীয় ধাপ৷ সূর্য ডোবার আগে মাটির কলসি গাছে এমন ভাবে ঝুলিয়ে দিতে হয় যাতে কলসির মুখটা কাঠির নিচে থাকে৷ সারারাত ধরে কলসিতে জমা হতে থাকে রস। পরদিন ভোরবেলা, সূর্যের আলো ফোটার আগে গাছ থেকে কলসি নামিয়ে নিতে হয়৷ কুয়াশাময় শীতের ভোরে যা খুব কঠিন কাজ। এই কলসিগুলি প্রতিদিন চুন দিয়ে ধুয়ে ভাল কর শুকিয়ে নেওয়া প্রয়োজন আর গাছের কাটা অংশও জল দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। এই পদ্ধতির কোন একটির ভুল হলেই খেজুর রস ‘গেঁজে’ যেতে পারে যা আসলে তাড়িরই এক রূপ।

এরপর নলেন গুড় তৈরির তৃতীয় তথা শেষ ধাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ৷ ভাল গুণমানের নলেন গুড় তৈরি করতে তৃতীয় ধাপে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার প্রয়োজন৷ মাটির উনুনে কাঠের জ্বালানি ব্যবহার করে রস ফোটাতে হয়৷ রস ফোটার সময় তার মধ্যে বিশেষ ধরনের হাতা দিয়ে সারাক্ষণ নাড়তে হয়৷ মূলত নারকেলের মালার অর্ধেক অংশে লম্বা কাঠ লাগিয়ে এই হাতা তৈরি করা হয়৷ কয়েক ঘণ্টা ধরে রস ফোটাতে হয়৷ যত সময় এগোয়, ততই নলেন গুড়ের গন্ধ পাওয়া যায়৷ গন্ধ যত বাড়বে, বুঝতে হবে গুড়ের মান ততই ভাল হচ্ছে৷ তবে অনেকে গুড়ের রং হালকা করার জন্য সোডিয়াম হাইড্রোজেন সালফাইট (হাইড্রোজ) ব্যবহার করে থাকেন যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

গুড়ের গুণমান রসের উপর নির্ভর করে৷ টানা তিনদিন রস সংগ্রহের পর বন্ধ করে দিতে হয়৷ একে বলে গাছের জিরেন৷ কারণ, প্রতিদিনই গাছে হাঁড়ি ঝোলানোর সময় কান্ডের কিছুটা অংশ চাঁছতে হয়৷ গাছকে জিরেন দিলে ওই তিন দিন, তা চাঁছতে হয় না৷ এর পর চতুর্থদিন বা জিরেনের পর প্রথমদিন যে রস সংগ্রহ করা হয়, তার স্বাদ অন্য রসের তুলনায় একেবারেই আলাদা৷ এই রস জিরেন-কাটের রস নামে পরিচিত৷ জিরেন-কাটের রস থেকে জিরেন-কাটের গুড় তৈরি হয়৷ এই গুড়ের স্বাদ সব থেকে ভাল৷

ব্যবসায়িক স্বার্থে মিশছে ভেজাল, বা জিরেন কাটের নলেন গুড়ের হয়ে উঠছে অপ্রতুল তবুও নলেন গুড় বা খেজুর গুড়ের স্বাদ নেওয়ার জন্যে বাঙালি শীতকালের অপেক্ষায় থাকে। খেজুর গুড়ের পাটালি তৈরি করে অনেক সময় সারা বছরের জন্যে মজুদ করার ব্যবস্থা করলেও মজুদ করে রাখা পাটালি থেকে তৈরি মিষ্টির স্বাদ বা গন্ধ কোনটাই টাটকা গুড়ের মত হয় না। তাই শীতের কটা দিন নলেন গুড় ও তার থেকে তৈরি নানান মিষ্টি উপভোগ করে নেওয়াই ভাল।

ভাল গুড় কিনতে গেলে কয়েকটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে। আসলে খাঁটি নলেন গুড় চেনা খুবই সহজ। প্রথমে যেটা করবেন, গুড় কেনার সময় তা সামান্য পরিমাণ নিয়ে জিভে দেবেন। যদি নোনতা স্বাদ পান, তা হলে বুঝে নেবেন ওই গুড়ে ফটকিরি মেশানো আছে।

নলেন গুড়ের পাটালি একদম নরম হয়। আঙুল দিয়ে হালকা চাপ দিলেই গুঁড়া হয়ে যায়। শক্ত পাটালি হলে সেটা নলেন গুড় নয়।

নলেন গুড়ের রঙ গাঢ় বাদামি। গুড়ের রঙ হালকা হলে তাতে নিশ্চিত চিনি মেশানো আছে। অনেক সময় রঙ লালও হতে পারে। রাসায়নিক না মেশালে এমন রঙ হয় না।

ঢাকাটাইমস/০৮ জানুয়ারি/আরজেড)