১০০ সেতু উদ্বোধন ও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

প্রকাশ | ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:৩৪

মো. সাখাওয়াত হোসেন

উন্নয়ন সবাই চায় কিন্তু সব নেতৃত্বের মাধ্যমে উন্নয়ন সাধিত হতে পারে না। উন্নয়নের জন্য স্বপ্ন দেখতে হয়, স্বপ্ন দেখাতে হয় এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে সদলবলে মাঠে নেমে কাজ করতে হয়। বেশ কিছু দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে বিশেষ করে বিগত এক দশক থেকে বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের যে বাস্তব চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটি অত্যন্ত আশাজাগানিয়া এবং বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ এ কৃতিত্বের দাবিদার।

তদুপরি বর্তমান সরকার প্রধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, আগ্রহ ও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর দূরদর্শিতা বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে উৎকর্ষতা প্রদান করে থাকে। তারই একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, সম্প্রতি একযোগে দেশব্যাপী দেশের ১০০টি সেতু উদ্বোধনের বিরল ঘটনা বাংলাদেশের স্পষ্টত উন্নয়নকে আরও সুদৃঢ় করবে।

১০০ সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে দেশে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৩ মিটার সেতু পুনর্নির্মাণ ও ২১ হাজার ২৬৭ মিটার কালভার্ট নির্মাণ করে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে সরকার মহাসড়ক তৈরি করছে। সেতু হচ্ছে চার লেন ও ছয় লেনের।বাংলাদেশ শুধু দেশের অভ্যন্তরে না, এশিয়ান হাইওয়ে ও এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে সরকার। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থায় যেন বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে বিভিন্ন সড়ক, সেতু ও রেল ব্রিজ নির্মাণে কাজ করছে সরকার।

সরকারি অর্থায়নে সাত বিভাগে ২৫টি জেলায় ১০০টি সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এই সেতুগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৪৯৪ দশমিক ১৩ মিটার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা বিভাগে সেতুর সংখ্যা ৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৬টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬টি, সিলেট বিভাগে ১৭টি, বরিশাল বিভাগে ১৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৭টি এবং রংপুর বিভাগে ৩টি। খবরে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৫০৮টি সেতু এবং ৭ হাজার ৪৯৮টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সারা দেশে নির্মীয়মাণ রয়েছে আরও ১১৮টি সেতু, যা আগামী বছর কাজ শেষ হবে। পার্বত্যাঞ্চলে আরও ১১৫টি সেতু নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকল্পগুলো শেষ হলে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আরও সহজ ও উন্নত হবে এবং এর ফলশ্রুতিতে সুবিধা পাবে দেশের আপামর জনসাধারণ। এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি, মজবুত হবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত।

অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকগণ দেশের টেকসই উন্নয়নের ব্যাপারে জোরালো মতবাদ প্রদান করে থাকেন। কেননা, টেকসই উন্নয়ন এমন একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা যেখানে প্রত্যেকটি উইংকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগরুক রাখা যায় এবং সর্ব পরিস্থিতিতে সবগুলো উইং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রাষ্ট্রের সুগঠিত সমাজকাঠামোর সাথে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভূত বিষয়গুলো একটির সঙ্গে অন্যটি জড়িত এবং সবগুলোর নিবিড় সম্পর্কের প্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।

সে হিসেবে বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতির মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যোগাযোগব্যবস্থা। তবে একটা সময় যোগাযোগের জন্য নদীপথের উপর নির্ভর করা হত, তবে বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে অধিকাংশ যোগাযোগ সড়ক পথেই হয়ে থাকে। সে কারণেই বলা হয়, একটি দেশের পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ যত উন্নত, সে দেশের অর্থনীতিও তত মজবুত ও টেকসই। সুতরাং সার্বিক কারণেই উন্নয়নের বার্তা নিয়ে সরকার জনগণের কাঙ্খিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের নিমিত্তে যোগাযোগব্যবস্থায় ব্যাপক নজর দিয়েছে এবং তার ফলাফল হচ্ছে একযোগে দেশব্যাপী ১০০ সেতুর শুভ উদ্বোধন। উন্নত সড়কব্যবস্থা একটি দেশের উন্নয়নে বহুমুখী ভূমিকা পালন করে থাকে বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাজারব্যবস্থার উন্নতি, মানুষের কর্মসংস্থান, সম্পদের সুষম বণ্টনে সহযোগিতা এবং সর্বোপরি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কোন বিকল্প নেই। প্রকৃতঅর্থে, যোগাযোগব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে আবর্তিত হয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। যোগাযোগব্যবস্থার প্রকৃতির উপর নির্ভর করেই দেশের কৃষিজাত দ্রব্যাদি, শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী ইত্যাদি পরিবহনের ব্যয় নির্ধারিত হয়। পরিবহন ব্যায় নাগালের মধ্যে রাখা গেলে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় এবং প্রকৃত চাষী কাঁচামালের প্রকৃত মূল্য পায়। পরিবহন ব্যবস্থায় স্বল্প ব্যয় ও সহজল্যতার কারণে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে, কৃষক ভাল দাম পায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। সার্বিক কারণেই যোগাযোগব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কেননা পরিবহন বন্ধ থাকলে দেশের অর্থনৈতিক সচলতা স্থবির হয়ে পড়ে।

বর্তমান সরকারের শাসনামলে সড়কব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, ব্রীজ, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণে সরকার ফিজিবিলিটি টেস্ট করে প্রয়োজন মোতাবেক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিকল্পে প্রকল্প গ্রহণ করছে এবং প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা ও উদ্যম দেশের উন্নয়নকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ও গতিশীল করেছে এবং অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা প্রদান করেছে রাষ্ট্রকে।

গ্রাম হবে শহর—এ স্লোগানকে সামনে রেখে সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত আধুনিক ও উন্নত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং এর সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ। সমসাময়িক সময়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আসা যাওয়া করা যায়। বলাবাহুল্য, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের পরিবহনব্যবস্থা পূর্বের তুলনায় উন্নতি করেছে।

দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে জেলা শহরের সহজ যাতায়াতব্যবস্থা এবং বিভাগীয় শহরের ইজি এক্সেস গ্রামীণ মানুষের জীবনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে, এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ উন্নত ও টেকসই সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহসের পরিচয় দিবে।

পরিশেষে ১০০ সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সরকার জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাকে তুলে ধরেছে। সরকারের তরফ থেকে সারাদেশের মানুষের জন্য যোগাযোগব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করার জন্য কর্মপ্রচেষ্টার যে বহি:প্রকাশ তা নিঃসন্দেহে সাধারণ জনগণকে দেশমাতার তরে কাজ করার অনুপ্রেরণা প্রদান করবে। সরকার সারাদেশের যোগাযোগ খাতকে সহজতর করার প্রক্রিয়া হিসেবে একযোগে ১০০ সেতুর উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিত্রকেও তুলে ধরতে চেয়েছেন। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে আরও এগিয়ে যাবে। এ দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন জরুরী। সে জন্যই নিজস্ব উদ্যোগে নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে সরকার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। দৃষ্টিনন্দন হাইওয়ে, চার লেন, ছয় লেন রাস্তা, ফ্লাইওভার নির্মাণকরে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে তুলে ধরেছে।আমরা প্রত্যাশা করি, চলমান মেগা প্রজেক্টগুলো দ্রুত শেষ করে উন্নয়নের সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে জনগণের মিলিত অগ্রযাত্রার ফসল হচ্ছে আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে সরকারের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে আরও নতুন নতুন মাইলফলক সংযুক্ত হবে। এ ধরনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, গ্রামে নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপকতা কালক্রমে প্রসারিত হবে। কাজেই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ১০০ সেতুর উদ্বোধন মূলত সাহসী ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এবং আশা রাখি এ ধরনের পদক্ষেপ এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রতিনিয়ত সংযোজিত হবে।

    

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়