ঘোড়দৌড়

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৩৫

রেজাউল মাসুদ

শৈশবের যত আনন্দময় সুখস্মৃতি রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘৌড় দৌড় মেলা দেখা। স্পষ্ট মনে পড়ে অগ্রহায়ণ মাসের ধান কাটা শেষ, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, আমাদের পাশের গ্রামে দুই তিন বর্গকিমি এলাকা নিয়ে খোলা মাঠে এ ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। গ্রামের ভাষায় আমরা এটাকে পহুরা বলতাম। স্কুলের পরীক্ষা শেষ করে আগে থেকেই আমরা শীতকালে গ্রামের এই প্রাণের উৎসব পহুরার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম।

সুনিবীড় ছায়া ঘেরা গ্রাম আটাপাড়া। এই গ্রামে বাস করতেন আব্দুল জব্বার। তার নেশা ছিল ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। সারা বছর তিনি ঘোড়াকে প্রস্তুত করতেন। কখনো কোন দৌড়ে তার ঘোড়া প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হতো না। তাঁর মতোই শক্তিশালী ছিল তাঁর ঘোড়াটি। যে ঘোড়ায় চড়ে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে শুরু করে সব জায়গায় যেতেন ঘোড়ায় চড়ে। তিনি আর কেউ নন আমার ছোট ফুপা। তিনি এলাকার শ্রেষ্ঠ ঘৌড় দৌড়বিদ হিসাবে বেশ সুনাম সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন।ফুপাদের ঘরে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি আর নানা পুরস্কারে ভরে থাকত সবসময়,আশে পাশের উপজেলা এমনকি জেলা গুলোতেও নিয়মিত এই প্রতিযোগিতার আয়োজন হত, ফুপার কদর ছিল সর্বত্র,সব প্রতিযোগিতায় তার অংশগ্রহন এবং পুরস্কার জেতাটা ছিল অনেকটা সুনিশ্চিত।তাই ফুপার আগ্রহ আর পরিচালনায়ই তাদের গ্রাম আটাপাড়ায় প্রতিবছর পৌষ মাসের প্রথম দিন জমজমাট এ মেলা অনুষ্ঠিত হতো।ফুপাতো ভাই সমবয়সী হওয়ায় এই মেলাকে ঘিরে আমার আকর্ষনটাও একটু বেশীই থাকত।

ঘোড়সওয়ারের বাঁশির আওয়াজে ঘোড়া ছুটে চলতো দুর্বার গতিতে। হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রাস্তা ও বিলের বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আপন মনে উপভোগ করতো ঘোড়দৌড়। পূর্ব জামালপুরে আটাপাড়ার এই মেলাকে ঘিরে  আশে পাশের সব গ্রামে উৎসব আমেজ বিরাজ করত।পাশ্ববর্তি জেলা ময়মনসিংহ শেরপুর টাঙাইল থেকেও দৌড়বিদসহ অনেক মানুষ এই মেলা উপভোগ করতে আসত। শিশুদের বিনোদনের জন্য থাকত নানা আয়োজন। সার্কাস, পুতুল নাচতো ছিলই। মাঠের বিশাল অংশ জুড়ে বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসে যেত নানান ব্যবসায়ীরা, মুড়ি মুড়কি জিলাপী পিয়াজো, নানান খেলার সামগ্রী  আর মিষ্টির দোকানে জমে উঠত পুরো মেলা এলাকা। রাত্রে চৌকির প্যান্ডেল আর হ্যাজাক বাতিতে যাত্রা -পালাগানও ছিল এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ ।

বেশ কবছর হলো আমার ফুপা মারা গেছেন, মারা যাওয়ার আগে তার অসুস্হতাও ছিল দীর্ঘদিনের। ফুপার মতো আমুদে শৌখিন মানুষের আজ বড্ড অভাব, গ্রামের সেই জৌলুস আর নেই। ঘৌড়দৌড়ও তেমন নেই। আমাদের এলাকার কোথাও আর এই মেলার দেখা মেলেনা।পরবর্তি জেনারেশন তথা লাবিবাদের শুধু গল্পে অথবা ছবিতেই এ মেলাকে বুঝানো যাবে।দেশের গুটিকয়েক এলাকায় গ্রাম বাংলার এতিহ্যবাহী এই ঘৌড়দৌড় মেলাটি হয়তবা এখনও টিকে আছে কোথাও!!

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা