সামরিক বাহিনীর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও রোবট ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে নৈতিক যুক্তি

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৬ | প্রকাশিত : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৩৮

যুদ্ধ একটি অতি বিতর্কিত বিষয়। [১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ আমরা দেখেছি তার ভয়াবহতা ও দুর্ভোগ আমরা আজও ভুলিনি। ভুলতে পারা যায় না]। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন, সামরিক প্রয়োজনীয়তার মতবাদ, যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষর ক্ষতি করার অনুমতি দেয়। এসব মতবাদের আলোকে যুদ্ধ যদিও ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনে, তথাপি যুদ্ধ করাটা নৈতিক- কারণ, সেখানে এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে যে, যুদ্ধ না করলে এমন কিছু ঘটতে পারে যা নৈতিকভাবে ক্ষতিকর (রেড ক্রস এর আন্তর্জাতিক কমিটি ২০১৫)।

যেমন, যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত হতে পারে নৃশংসতা প্রতিরোধের জন্য। ন্যায় যুদ্ধ তত্ত্বের উদ্দেশ্য হলো- মানদণ্ড তৈরি করা যা নিশ্চিত করে যে যুদ্ধ নৈতিকভাবে ন্যায়সঙ্গত। ন্যায় যুদ্ধ তত্ত্ব যুদ্ধে যাওয়ার একটি নৈতিক মানদণ্ড (jus ad bellum) প্রদান করে এবং যুদ্ধ পরিচালনার নীতিমালা প্রদান করে (jus in bello)। ন্যায় যুদ্ধ তত্ত্ব যুদ্ধে যাওয়ার মাপকাঠিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে: যুদ্ধের ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে হবে, তুলনামূলক ন্যায়বিচার করতে হবে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে, যুদ্ধের সঠিক উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে হবে, যুদ্ধে সাফল্যের সম্ভাবনা বিবেচনা করতে হবে, শেষ অবলম্বন যুদ্ধ সেটা প্রমাণ করতে হবে এবং যুদ্ধের সমানুপাতিকতার নীতি অনুসরণ করতে হবে।

যুদ্ধ পরিচালনার মানদণ্ডে অন্তর্ভুক্ত থাকে: পার্থক্য, আনুপাতিকতা, সামরিক প্রয়োজনীয়তা, বন্দিদের সাথে ন্যায্য আচরণ, যুদ্ধ এবং যুদ্ধের উপায় ও পদ্ধতি অনুসরণে যেগুলো ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। উদাহরণস্বরুপ, যুদ্ধের নিষিদ্ধ পন্থায় রাসায়নিক এবং জীবাণু অস্ত্র অন্তর্ভুক্ত- অর্থাৎ, কোনোভাবেই যুদ্ধের উপায় হিসেবে রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না এবং যদি সেটা করা হয় তবে তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

আরও উল্লেখ্য যে, যুদ্ধে নিষিদ্ধ পন্থার মধ্যে রয়েছে গণধর্ষণ এবং যুদ্ধবন্দিদেরকে তাদের নিজস্ব পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা যাবে না। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধে যারা শিকার তাদের অধিকারকে রক্ষা করা। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে বেসামরিক ক্ষতি কমানোর নিয়ম রয়েছে।

যুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবট ব্যবহারের বিষয়ে কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবট ব্যবহার হলো স্বশাসিত সামরিক ব্যবস্থা যা বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমাতে পারে (আরকিন, ২০১০)। মানুষের বিপরীতে কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমান রোবটদের আবেগের অভাব থাকে এবং এইভাবে প্রতিহিংসার কাজ এবং আবেগ চালিত নৃশংসতা রোবটের হাতে ঘটার সম্ভাবনা কম।

আসলে এটা হতে পারে যে, রোবট নিযুক্ত নির্ধারিত কাজ সম্পাদনের জন্য ও নির্মিত নিয়ম মেনে চলার জন্য। সুতরাং, বেসামরিক আদেশ অমান্য এবং শত্রু যোদ্ধা অধিকার রোবট ক্ষুণ্ন করতে পারে না। (আরকিন ২০০৮)। অন্য কিছু না হলে, ইউনিট দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এমন একটি সামরিক রোবট এই ধরনের নৃশংসতা কম করতে পারে। যদি, রোবট নৃশংসতা প্রতিরোধ করতে এবং বেসামরিক হতাহতের হ্রাস নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে, তাহলে সামরিক নেতাদের এই ধরনের রোবট ব্যবহার করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। তবে এই ধরনের রোবট ব্যবহার করে একটি বৃহত্তর সংখ্যার বেসামরিক ব্যক্তি হত্যা নিন্দনীয়। অধিকন্তু, একটি AWS অপ্রাণঘাতী আক্রমণাত্মক কর্মে সক্ষম হতে পারে যেখানে মানুষ ইউনিটগুলোকে অবশ্যই প্রাণঘাতী বল ব্যবহার করতে হবে।

অন্যরা যুক্তি দেয় যে, AI এবং সামরিক রোবটগুলো প্রতিরক্ষামূলক উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয়। কিছু গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যেমন এরিয়েল যুদ্ধ, স্বায়ত্তশাসিত মানব সিস্টেমের তুলনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ রোবট সিস্টেমের সুস্পষ্ট সুবিধা রয়েছে (Ernest et al. ২০১৬)। তাই, একটি AWS-এর সাথে লড়াই করার জন্য মানুষকে পাঠানো সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং এর ফলে হতাহতর পরিমাণ বেশি হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নেতাদের একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে তাদের নিজেদের হতাহত কমাতে, সেটা হলো- নিজস্ব প্রতিরক্ষায় স্বশাসিত যুদ্ধ ব্যবস্থার (AWS) বিকাশ ঘটাতে হবে ।

তবে স্বশাসিত যুদ্ধ ব্যবস্থা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য রায় দিলে অস্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন দেশের মাঝে অশুভ অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৭ সালের দিকে বলেছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যে দেশ নেতা হবে সেই বিশ্বকে শাসন করবে।’ আমরা আজ রাশিয়াকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখছি এবং তার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়ছে। আমাদের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী ও সংকটময়। অন্যদিকে, ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীকে ভিন্নমতের মানুষদেরকে হত্যা করছে বলে আমরা শুনছি।

আমরা বিগত ৫ বছর ধরে ১০ লাখ রোহিঙ্গাদেরকে ধারণ করছি। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে যদি মায়ানমার ড্রোন, রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে আমাদের কী করণীয় হতে পারে সেটা নিয়ে ভাববার সুযোগ যেমন আছে, তেমনি বিষয়টি অনিবার্য ও অতি জরুরি।

আমরা গবেষণা থেকে জানি, চীন স্বশাসিত যুদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট আছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই তাদের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে এবং সেগুলোর ব্যবহার আমার দেখছি। আমরা এটাও জানি কিভাবে মালোয়েশিয়ায় একটি বেসামরিক বিমান ধ্বংস করা হয়েছে। স্বশাসিত যুদ্ধ ব্যবস্থা সৈনিক স্বল্পতাকে পূরণ করতে পারে বিধায় এই ব্যবস্থার প্রতি আসক্তি অনিবার্য। এরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ‘যন্ত্র দিয়ে মানুষ হত্যা অমর্যাদার বিষয়’ বিবেচনা করে নৈতিকতাকে সংজ্ঞায়িত করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন নীতি দার্শনিকেরা।

অনুবাদ [Christoph Bartneck, Christoph Lütge, Alan Wagner,Sean Welsh- An Introduction to Ethics in Robotics and AI গ্রন্থ থেকে]

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :