রাশিয়ার বোমা বনাম আছিয়ার উনুন
প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:৪০
গ্রামের ভেতর থেকে যে পিচ ঢালাই রাস্তাটি মনোয়ার সাহেবের বাড়ি হয়ে মনোয়ার সাহেবেরই জমি হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো, সেটি মনোয়ার সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত গেলো ঠিকই, কিন্তু পরে তা মনোয়ার সাহেবের জমি না ডিঙিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে গহুর মিয়ার জমিটা দুভাগ করে দিয়ে গেলো।
গহুর মিয়া অনেক কান্নাকাটি করলো। মেম্বার-চেয়ারম্যান ধরলো, রাজনীতিওয়ালাদের ধরলো। মনোয়ার সাহেবকে তো ধরলোই। মনোয়ার সাহেব চেয়ারম্যানের মা-বাপ; রাজনীতিওয়ালারাও ভীষণ সমীহ করে তাকে।
দিনের পর দিন এদের পেছন-পেছন ঘুরে, পায়ের কাছে বসে থেকেও সময়ের ক্ষতি ছাড়া গহুর মিয়ার লাভ হলো না কিছুই।
গহুর মিয়া কান্নাকাটি করলে চেয়ারম্যান বুঝালো, এটা সরকারি কাজ, অনেক আগে থেকেই নকশা করা, সরকারি পরিকল্পনার কোনো হেরফের হয় না কি?
হেরফের হয়েছে তো। রাস্তা তো মনোয়ার সাহেবের জমি হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। এখন তা গহুর মিয়ার জমি দ্বিখণ্ডিত করবে কেনো? এ প্রশ্ন গহুরের মনে ঘাই মারলেও তা প্রকাশ করতে পারে না চেয়ারম্যানের কাছে।
মনোয়ার সাহেবের পায়ের কাছে পড়ে থাকলে সে শোনালো নতুন কথা, তুই তো বোকার হাড্ডি, কী কপাল তোর! এতো সুন্দর রাস্তা হচ্ছে, এই রাস্তা দিয়া কতো সহজে ফসল নিয়া বন্দরে বেচতে যাবি! ভালো দাম পাবি। যাতায়াতের অসুবিধায় তোর শাক-সবজি ক্ষেতে পচে না বল? রাস্তা হইলে দেখবি তোকে বন্দরেও যেতে হবে না, শহরের পাইকাররা তোর ফসল কিনতে জমিতে এসে পড়বে।
গহুর দুহাত কচলায়, মনোয়ার সাহেবের কথা আধো আধো বিশ্বাস হলেও, মোটেই আস্থা আসে না। মিনমিন করে বলে, কিন্তু আমার জমিটা তো দ্বিখণ্ডিত হইয়া গেলো মিয়াভাই।
মনোয়ার সাহেব রেগে উঠে, এই হচ্ছে অশিক্ষিত বাঙালি চাষা-ভূষার দোষ। নিজেদের ভালোটা নিজেরা বোঝে না। তোদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে, তোরা একটি পাকা রাস্তা পেয়েছিস। যা যা মসজিদে গিয়ে মিলাদ দে, আর যারা তদবির করে রাস্তাটা এনেছে তাদের নামে একটু দোয়া-খায়ের কর।
কপালে হাত রাখা ছাড়া গহুরের আর কিছুই করার থাকে না।
রাস্তার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলে তারপর থেমে থাকে দীর্ঘদিন। তারপর আবার কাজ শুরু হয়। স্তরের পর স্তর বালু ভরাট করে রাস্তাটা দাঁড়িয়ে যায়। তারপর ইট বিছিয়ে রোলার দেওয়া হয়। আবার কাজ থেমে থাকে। আবার কিছু দিন পর শুরু হয়। নুড়িপাথর আর পিচের প্রলেপ দিয়ে রাস্তাটা হয়ে যায় একদিন।
জমির উঁচু অংশে ও জমি লাগোয়া কান্দিতে শাক-সবজি চাষ করলেও মূল জমিতে যে ধান ফলে তা-ই গহুর মিয়ার পরিবারের প্রধান সম্বল। এই ধানই গহুরের পরিবারে অন্ন যোগায়। এই ধান ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতেও পারে না গহুর-আছিয়ার পরিবার।
জমি দ্বিখন্ডিত করে রাস্তার কাজ যখন শুরু হয় তখন গহুর শুধু দুঃশ্চিন্তা করেছে—তার জমিটা নয় যেন তার হৃদয়টা দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে, সাথে সাথে প্রায় দশ শতক জমিও গেছে। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতে, ধান রোপনের আবার উপযুক্ত সময় এলে বুঝতে পারলো রাস্তার উত্তর পাশের জমিটা যৌবন হারাচ্ছে। দক্ষিণ পাশের জমি জোয়ারে প্লাবিত হয়, পলি পড়ে, সেঁচের অভাব হয় না। চাষ করতে কোনোই সমস্যা হয় না। পরিপূর্ণ যুবতী। কিন্তু রাস্তার উত্তর পাশের জমিতে এখন আর জোয়ারের জল আসে না। পলি ও সেঁচের অভাবে বন্ধ্যা হতে বসেছে। গহুর মিয়ার পরিবারের সদস্যদের কান্নায় যদি সেঁচের কাজ হতো, তবে দিন-রাত কেঁদে কেঁদে মাঠ ভাসাতো। কিন্তু এখন কান্নার সময় নেই। কপালে হাত দিয়ে বসে থাকারও সময় নেই। গহুর মিয়া বুঝলো অযথা মেম্বার-চেয়ারম্যান বা মনোয়ার সাহেবের পেছন পেছন ঘুরেও লাভ নেই। দুই দিন উপজেলা কৃষি অফিসে ঘুরে কিছু তাত্ত্বিক জ্ঞান পেলো কিন্তু সেঁচের কোনো উপায় হলো না।
কৃষি অফিস থেকে পাম্পের সাহায্যে সেঁচকার্য চালানোর পরামর্শ দেয়। কিন্তু ঘুর পথে খাল থেকে লাইন টেনে পাম্প চালানো যেমন অধিক ব্যয়বহুল, তেমনি পাম্প ভাড়া ও তেল খরচ চালানোর সামর্থ গহুরের নেই। বাধ্য হয়ে গহুর পনেরো ও তেরো বছরের দুই ছেলে নিয়ে ক্ষেতে নেমে পড়ে, ক্ষেতের মাঝে কূপ খননের কাজে নামে। এ জন্য আনোয়ার ও মনোয়ারের স্কুল কামাই যায়।
গহুর কোমরে গামছা বেঁধে শক্তহাতে খন্তা ধরে মাটি কেটে দেয়, আর আনোয়ার-মনোয়ার সে মাটি তুলতে থাকে।
আনোয়ার-মনোয়ার ক্লান্ত হলে কিছু সময় জিরিয়ে নেয়, পানি খায়, চিড়ে-গুড় খায়; গহুর কারিকর বিড়িতে টান দেয়। তারপর আবার কাজে নেমে যায়।
দুপুর এলিয়ে পড়লে আছিয়া বেগম খাবার নিয়ে আসে। কূপে ওঠা ওল্প-ওল্প পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে ওরা কান্দিতে গামছা পেতে খেতে বসে। খাওয়া শেষে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার মাটি কাটায় লেগে যায়।
এবার আছিয়া বেগমও হাত লাগায়। রান্না-বান্না ও সাংসারিক কাজের ব্যস্ততায় দিনের প্রথম ভাগে কাজে যোগ দিতে পারেনি। এবার স্বামী-সন্তানের সাথে একযোগে কাজ করে। কোলের শিশুকে বাড়িতে রেখে এসেছে দশ বছর বয়সী মেয়েটির কাছে।
আছিয়া বেগম আসায় দ্রুত কাজ এগুচ্ছে। দ্রুত কূপে পানি চলে আসছে। কূপের পানি সেঁচে আবার মাটি কাটছে তারা। আবার পানিতে ভরে যাচ্ছে কূপ। তাদের মুখে হাসি ফোটে।
এবার জমির ভেতর থেকে সব দিক দিয়ে সরু-সরু নালা করার পালা। যাতে সেঁচের পানি জমির সব জায়গায় ছড়িয়ে যায়।
দিন-রাত পরিশ্রম করে সেঁচ দেয় গহুরের পরিবার। সেঁচ ভালোই হচ্ছে ভেবে আনন্দিত হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই দেখে ধানের পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। গহুরের আবার কপালে হাত। আবার এখানে-সেখানে ছোটাছুটি। কৃষি অফিস থেকে ইউরিয়া ছিটানোর পরামর্শ দেওয়া হলো। কোনো উপায় না দেখে ঋণ করে ইউরিয়া ছিটায় গহুর। সমানে সেঁচকার্য চালিয়ে যায়।
অবশেষে গহুর বুঝলো প্রকৃতির কাজ কল দিয়ে চালানো যায়, কিছুতেই দৈহিক বল দিয়ে তা সম্ভব নয়। পরিবারের সব লোক রাতদিন খাটলেও তা কলের সমকক্ষ নয়। গহুর আরো ভাবে-বৃত্তবান, বলবান আর ঈশ্বর কেউই গরিবের পক্ষে নয়। আর বিপক্ষে জেনেও তাদের কাছেই বারবার হাত পাততে হয়।
রাস্তার দক্ষিণ পাশে ধান মোটামুটি ভালোই হলো। কিন্তু উত্তর অংশের জমিতে উৎপাদন খরচ তো বহু দূরের কথা, ধান কাটার খরচই উঠলো না। উত্তর অংশে যে ধান হলো তা দিয়ে আর কদিন চলবে! রাস্তা তো হলো, কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে এখন কী বিক্রি করতে বন্দরে যাবে গহুর! ঋণ পরিশোধ করবে কি দিয়ে!
পরবর্তী বছরে তো জমি আরো যৌবন হারাবে। গহুর মিয়া কিছু ভেবে না পেয়ে মনোয়ার সাহেবের কাছে ছোটাছুটি করে। অবশেষে নামমাত্র মূল্যে রাস্তার উত্তর পাশের জমিটা মনোয়ার সাহেবের কাছে বিক্রি করে দেয়।
দলিলে টিপসই দেওয়া শেষ হলে মনোয়ার সাহেব বলে, এখন অর্ধেক টাকা রাখ, বাকি টাকা কদিন পরে নিস।
গহুরের হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
এক দিন এক দিন করে সময় চলে যায়। জমি বিক্রির টাকাটা পাওয়ার আশায় মনোয়ার সাহেবের বাড়ি অনেক বার গিয়েছে; কিন্তু মনোয়ার সাহেবের সাথে সাক্ষাত করা তো দূরের কথা, বাড়ির মধ্যেই প্রবেশ করতে পারেনি গহুর। দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে নিকটতম আত্মীয়-স্বজন ছাড়া মনোয়ার সাহেবের দরজা দিয়ে ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। তাই দরজার সামনেই অপেক্ষা করতে হয় গহুরকে। কোনো দিন গিয়ে শোনে সাহেব বাড়িতে আসেনি। কোনোদিন শোনে সাহেব ঘুমিয়েছে, এখন ডাকা যাবে না, কাল এসো। পরদিন গিয়ে শোনে, সাহেব জরুরি কাজে ঢাকায় গেছেন, ফিরতে দিন-দশেক লাগবে।
মনোয়ার সাহেবের সাক্ষাত প্রত্যাশায় ছুটতে ছুটতে গহুর অস্থির হয়ে পড়ে; টাকার চিন্তায় মাথা ঠিক থাকে না। যেটুকু জমি অবশিষ্ট আছে তাতে আর কতোই ফসল হবে! যে ধান হয়েছে এবার, তা তো আর ক’দি পরই শেষ হয়ে যাবে। তখন এতোগুলো পেট চলবে কি করে? মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় গহুরের। আছিয়া বেগমের সাথে ঝগড়া হয় প্রায়ই। ছেলে-মেয়েদের সাথে রাগারাগি করে। যখন-তখন ঘর থেকে বের হয়ে যায় গহুর মিয়া।
আজ আছিয়া বেগমের সাথে ঝগড়া শুরু হলে কিছু না খেয়েই বের হয়ে যায় গহুর। কিছুক্ষণ আলের উপর বসে থেকে তারপর রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। কখন যেন মনের ভুলে মনোয়ার সাহেবের বাড়ি পৌঁছে যায়। গহুর ভাবতেও পারেনি, আজ মনোয়ার সাহেবকে পেয়ে যাবে। মনোয়ার সাহেব বাগানে চেয়ার পেতে পত্রিকা পড়ছে। গহুর আনন্দ নিয়ে সামনে এগোয়। বড় করে সালাম দেয়।
মনোয়ার সাহেব সালামের উত্তর দেবে কি; চিৎকার করে উঠে-এই ওখানেই দাঁড়া! ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক।
গহুর ভয় পেয়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে। গহুরের ভয়ের চেয়ে মনোয়ার সাহেবের চোখে অধিক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যেন পালে পালে করোনাভাইরাস নিয়ে হাজির হয়েছে গহুর মিয়া।
মনোয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করে, তা কী ব্যাপার গহুর মিয়া?
গহুর অবাক হয়। সাহেব কি বেমালুম ভুলে গেছে টাকার কথা!
গহুর বিনয়ের সুরে বলে, মিয়াভাই, খুব অসুবিধায় আছি। টাকাটা লাগতো।
মনোয়ার সাহেব সিগারেট জ্বালায়। দীর্ঘ টান দেয়। তারপর ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে বলে, টাকাটা, ও টাকাটা; কিন্তু টাকাটা এখন কীভাবে দিই?
ভীষণ দরকার মিয়াভাই। না হলে আর চলছে না।
দিন-দুনিয়ার খবর কিছু রাখো? করোনায় সব শেষ। লকডাউনে ব্যবসা আর ব্যবসা নাই। করোনা নিয়ন্ত্রণে এলো। একটু ঘুরে দাঁড়াবো, কিন্তু দেখো, ওদিকে আবার শুরু হলো যুদ্ধ।
গহুর আতঙ্কিত হয়। যুদ্ধ! একাত্তরের মতো আবার যুদ্ধ শুরু হলো নাকি?
আরে না, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জানো না কিছু?
ইউক্রেন-রাশিয়া কোথায় তা জানে না গহুর। তবে বুঝতে পারে তা আমাদের কাছাকাছি নয়।
মুহূর্তেই গহুরের আতঙ্ক চলে যায়। গহুর বলে, ইউক্রেন-রাশিয়া তো আমাদের দেশে না, ওখানে যুদ্ধ হইলে আমাদের কী?
লেখা-পড়া করোনাই, বুদ্ধি কই পাবি? হাতিতে হাতিতে যুদ্ধ হইলে দূর্বা ঘাস থাকে? ওরা হইলো হাতি, আর আমরা হইলাম দূর্বা ঘাস, বুঝলি?
কিছুই বোঝেনি গহুর—কিসের হাতি, কিসের দূর্বা ঘাস, কিসের যুদ্ধ? শুধু বোঝে তার টাকাটা দরকার।
গহুর হাতজোড় করে বলে, দয়া করেন মিয়াভাই, টাকাটা খুব দরকার।
আমি কি দয়া করবো? তোর টাকা আমি দেবো না তা তো বলি নাই। বলছি এখন আয়-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। করোনায় ক্ষতি হলো। এখন আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে আছি ক্ষতির মধ্যে।
মনোয়ার সাহেব কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে, তুই এক কাজ কর গহুর।
কী কাজের কথা বলবে, শোনার জন্য কান খাড়া করে গহুর।
কী কাজ না বলে সিগারেটে লম্বা টান দেয় মনোয়ার সাহেব। তারপর চোখ বন্ধ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলে, আমার টাকা ফেরত দিয়ে তুই তোর জমি ফেরত নিয়ে যা। অন্য করো কাছে বিক্রি কর গিয়ে।
গহুর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। লেখা-পড়া না শিখলেও বুঝতে পারে এ-ও এক যুদ্ধের কৌশল। ভাবে, এ কী কথা বলছে মিয়াভাই! জমি ফেরত নিলে টাকা ফেরত দিবে কোথা থেকে? গহুর বলে, কী বলেন মিয়াভাই, আপনার কাছে জমি বিক্রি করেছি, এইটা আবার ফেরত নিবো, এইটা চিন্তা করাও পাপ। আমি গরিব মানুষ, যতো তাড়াতাড়ি পারেন আমারে বিপদ দিয়া উদ্ধার কইরেন মিয়াভাই।
যুদ্ধটা একটু নিয়ন্ত্রণে এলেই সব টাকা দিয়ে দিবে, এই আশ্বাস নিয়ে বাড়ি ফেরে গহুর মিয়া।
সন্ধ্যায় কিছু সবজি নিয়ে বন্দরে যায় গহুর। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের খবর নেয়। সবজি বিক্রি শেষে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে দীর্ঘ সময় নিয়ে চা খায় আর টিভিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের খবর দেখার চেষ্টা করে।
খারকিভে রুশ হামলা জোরদার। লুহানস্ক রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
গহুর সবকিছু বুঝে উঠতে পারে না। কাউকে পেলে যুদ্ধ বিষয়ে প্রশ্ন করে। দোকানি রাগ না করা পর্যন্ত বসে থাকে। তারপর সওদাপাতি কিনে ঘরে ফিরে।
এরপর থেকে যেদিন বিক্রির কিছু থাকে না সেদিনও শেষ বিকেলে গহুর মিয়া বন্দরে যায়। দোকানের পাশে দাঁড়ায়। বড় বড় চোখে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে—কখন যুদ্ধের খবর বলে।
রাশিয়ার দখলে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র। খেরসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় কিয়েভ। রাশিয়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেব, জেলেনস্কির ঘোষণা। ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়েছে মস্কো। ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। আরও সাড়ে ৭৭ কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা।
যুদ্ধের খবর প্রচারিত হলে গহুরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়, জিভ শুকিয়ে যায়, বুক ধরফর করে, যেন বোম এসে পড়ছে তার গ্রামে, গোলাবষর্ণে পুড়ে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি।
গহুরকে বিচলিত দেখে পাশ থেকে জহির মোল্লা বলে উঠে, কতো হাজার মাইল দূরে যুদ্ধ হচ্ছে, আর তুমি মিয়া এখানে বসে ভয়ে কাঁপছো!
গহুর সোজা হয়ে বসে। ভয় সে পেয়েছে ঠিক। জহির মোল্লা লেখাপড়া করা মানুষ। তার কথা শুনে ভরসা পায় মনে। কিন্তু এ যুদ্ধ না থামলে তো মনোয়ার সাহেবের কাছ থেকে জমি বিক্রির টাকা পাবে না। তাই যুদ্ধ সংক্রান্ত দুর্ভাবনা নিয়েই তাকে বাড়ি ফিরতে হয়।
দিন কয়েক যেতে না যেতেই যুদ্ধের ভয় একেবারে ঝাপটে ধরে। এ ভয় হতাহতে প্রাণ হারানোর নয়। কোথাকার যুদ্ধ এই গাঁয়ে এসে আছিয়া বেগমের উনুনের আগুন নিভিয়ে দিতে পারে তা কখনো ভাবেনি তারা। দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ছে। প্রায়ই রান্না হয় না ঘরে।
শীঘ্রই জমিতে সার ও কীটনাশক না দিতে পারলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু টাকা কোথায়? জমি বিক্রির কিছু টাকাও যদি পাওয়া যায় এই আশায় মনোয়ার সাহেবের বাড়িতে ছুটে গহুর। গিয়ে দেখে মনোয়ার সাহেবের দালানে নতুন করে রঙ করা হচ্ছে। পুরাতন প্রাচীর ভেঙে নতুন প্রাচীর করে নতুন ডিজাইনে গেট করা হচ্ছে।
গহুর এতো কাজ দেখে অবাক। ভাবে, তাহলে কি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ হইছে!
মনোয়ার সাহেব বারান্দায় বসে কাজের তদারকি করছে। পাশে বসা তার স্কুল পড়ুয়া নাতনি। গহুরকে আসতে দেখে নাতনিকে বলে, পড়তো দিদি, যুদ্ধের খবর গুলো পড়ো।
নাতনিটি সংবাদপত্র পড়তে শুরু করে—ছয় মাসের যুদ্ধে ইউক্রেনে ভৌত অবকাঠামোর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা সহজেই চোখে পড়ে। এক সময় যেখানে ছিলো ঘরবাড়ি এবং বড় বড় দালানকোঠা; সেখানে এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ।
...জাতিসংঘ বলছে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর এ পর্যন্ত অন্তত এক কোটি বিশ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চাশ লাখের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আর প্রায় সত্তুর লাখ মানুষ ইউক্রেনের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যাচ্ছে যুদ্ধের শুরু হতে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ হাজারের বেশি মানুষ ইউক্রেনে নিহত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
এ পর্যন্ত পড়ে নাতনিটি থামে। গহুর বারান্দার বাইরেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।
মনোয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করে, কী খবর গহুর?
মিয়াভাই আর যে পারি না। উনুনে আগুন জ্বলে না। সার কেনা লাগে, কীটনাশক কেনা লাগে। টাকা না পাইলে তো একদম মরন লাগবে।
শুনলি তো এতোক্ষুণ। কী যুদ্ধটা চলতেছে! পৃথিবীর অবস্থা ভালো না। এখন টাকার কথা মুখে আনিস না।
কদিন ধরে যুদ্ধের খবর দেখে দেখে যেন সাহসী হয়ে উঠেছে গহুর। এবার জবাব দিতে ভুল হয় না। তবে মনোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে নয়, মাথা নিচু করে বলে, মিয়াভাই, আমার জমি তো ইউক্রেনে না। আর আমি তো রাশিয়ায় জমি বেচিনাই। আমার জমি এই গাঁয়ে, এই গাঁয়ে আপনের কাছে বেচছি।
এ কথা শুনে মনোয়ার সাহেবের রাগ ধরে। চোখ লাল হয়ে যায়। উত্তেজিত স্বরে বলে, এই জানোয়ার, তোর জমি কি আমি শখ করে কিনছি? তুই বিপদে পড়লি বলে তোকে না কিছু নগদ টাকা দিয়া সাহায্য করলাম। ওই জমি কিনে আমার কী লাভ হইলো বল?
গহুর ভয় পেয়ে যায়, যেন রাশিয়া ক্ষেপনাস্ত্র ছুটছে তাকে লক্ষ্য করে।
একটু থেমে আবার মনোয়ার সাহেব বলতে থাকে, তোরে কোন বাপে টাকা দিত বল? কে কিনতো এতো দাম দিয়া তোর ওই নিষ্ফলা জমি?
গহুর এবার কাঁচুমাচু করে। থরথর করে কাঁপে। হাত জোড় করে বলে, আমার ভুল হইয়া গেছে মিয়াভাই। পেটে ক্ষুধা; মাথাডা ঠিক নাই। আমারে মাফ কইর্যা দেন।
গহুর বারান্দার বাইর থেকে মাথা নোয়ায় মনোয়ার সাহেবের পা বরাবর। মনোয়ার সাহেব এবার কিছুটা শান্ত হয়। গহুর ঝড়ে বিপর্যস্ত লাউডগার মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়।
মনোয়ার সাহেব বলতে থাকে, দেশের অবস্থা সাংঘাতিক খারাপ। জ্বালানি তেলের দাম কী হারে বাড়ছে! সব জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ের পরিস্থিতি খুবই খারাপ যাচ্ছে। তোকে তো বলেছি, টাকা ফেরত দিয়ে তোর জমি তুই নিয়ে যা। না হলে এই যুদ্ধ পরিস্থিতির ভেতর টাকা-পয়সা চাস না।
কী করবো মিয়াভাই; পরিবার যে মারা পড়বে।
এক কাজ কর। তোর মেয়েটারে আমার কাছে দে। আমার মেয়েটার কাছে ঢাকায় পাঠিয়ে দিই। আমার নাতি-নাতনিদের দেখবে। ওদের সাথে খেলবে। ভালো খাবার-দাবার খাবে। কিছু বেতনও দিবে না-হয়। আমি বলে দেবো। খুব যত্নেই থাকবে ও। আর ছেলেদেরও বেশি লেখা-পড়া করিয়ে কী লাভ? ওদের কাজে নামিয়ে দে। প্রয়োজনে আমায় বলিস, কাজ ঠিক করে দেবো।
আজ চলি মিয়াভাই।
গহুরের চোখে পানি চলে আসে। গামছা দিয়ে মুছে। তারপরও সবকিছু ঝাপসা লাগে। মনোয়ার সাহেবের দালানজুড়ে কতো বিচিত্র রঙের চিত্রণ করা হচ্ছে- কিন্তু গহুরের চোখে সবই ধূসর লাগছে।
খবর দেখতে আর বন্দরে যায় না গহুর। ইচ্ছেই জাগে না। দুচারটি শাক-সবজি, ক’হালি ডিম বা খাল-ডোবা থেকে ধরা কিছু মাছ নিয়ে বন্দরে গেলেও বিক্রি করে প্রয়োজনীয় সওদা নিয়ে দ্রুত ফিরে আসে। কারো কাছে জিজ্ঞেসও করে না যুদ্ধের খবর। পেটে কিভাবে দুমুঠো অন্ন দিবে, এটাই এখন বড় যুদ্ধ। বিক্রিত দ্রব্যের দাম ভালো পেলে হাসি ফোটে গহুরের ঠোঁটে, কিন্তু প্রয়োজনীয় সওদা কিনতে গিয়ে মূল্য বৃদ্ধি দেখে সে হাসি হাওয়ায় মিলায়। ঘেমে একাকার হয়ে যায় গহুর। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অতি প্রয়োজনীয় অনেক কিছু না কিনেই বাড়ি ফিরতে হয়।
এক বছরের আগেই রাস্তার পিচ উঠে গেছে। জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়েছে।
নতুন বরাদ্দ আসে। নতুন করে পিচের প্রলেপ পড়ে। সংস্কারে একদম নতুন হয়ে যায় রাস্তা। সাইসাই করে গাড়ি চলে। গহুর তার অবশিষ্ট ক্ষেতে বসে শব্দ শুনলেই গাড়ির দিকে তাকায়। ভাবে, তেলের দাম বাড়লেও তো গাড়ি চলা কমে না। উড়তি বয়সী পোলাপান মোটরসাইকেল নিয়া যেভাবে উড়াল দেয়, বোঝাইতো যায় না যুদ্ধ লাগছে, বোঝাই তো যায় না তেলের দাম বাড়ছে।
গহুর কাজের ফাঁকে গিয়ে বিক্রি করা জমিটার দিকে তাকায়। অনাবাদি পড়ে আছে জমি। গহুরের অন্তর হু-হু করে উঠে। গহুর জন্মের পর থেকে কোনোদিন দেখেনি জমিটিকে অনাবাদি পড়ে থাকতে। এমনকি একাত্তর সালেও না। যদিও স্বাধীনতার বছর ধান ঘরে তুলতে পারেনি। কিন্তু জমি তো অসহায় পড়ে থাকেনি। লোকমুখে শুনেছে গহুর, এ জমি নাকি শীঘ্রই মনোয়ার সাহেব বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলবে। এখানে নাকি কারখানা হবে। গহুর এসব কথা ভাবে, কিন্তু চোখের জল কিছুতেই বেঁধে রাখতে পারে না।
রাস্তা সংস্কারের কাজ শেষ হতে না হতেই মনোয়ার সাহেব একখানা গাড়ি কিনেছে, ভালো বেতনে ড্রাইভার রেখেছে। গ্রামের শিশু-বাচ্চা, নবীন-প্রবীণ, বৃদ্ধ সবাই ভীড় করেছে গাড়ি দেখতে। এ গাড়িতে তারা কোনোদিন চড়তে পারবে না, তবু রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির চেয়ে এ গাড়িখানাকে তাদের আপন মনে হয়। ঘুরে ঘুরে দেখে। আলতো হাত ছোঁয়ায়।
গহুর মিয়াও এসেছে গাড়ি দেখতে। এই সুযোগে যদি মনোয়ার সাহেবের সাথে দেখা হয়, আর ভাগ্য ভালো হলে যদি টাকার কথা তোলা যায়, আর কপাল খুললে যদি টাকাটা পাওয়া যায়।
গহুরকে দেখে মনোয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করে, কিরে গহুর, গাড়িখান কেমন হইলো?
গহুর বলে, জব্বর হইছে মিয়াভাই।
মনোয়ার সাহেব গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় গহুর মিয়া প্রশ্ন করে, মিয়াভাই, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কি শ্যাষ হইছে?
মনোয়ার সাহেব কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে দরজায় টান দেয়। শব্দ করে দরজাটা আটকে যায়। ভয় পেয়ে গহুর আৎকে উঠে। মনেপড়ে, ঘরে চাল নেই, তেল নেই। আছিয়ার উনুনে আগুন জ্বলবে না আজ।